হরপ্পা সভ্যতা : হরপ্পা সভ্যতার নামকরণ ও সময়কাল, হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা, হরপ্পা সভ্যতার ব্যাপ্তি - আসল ব্যাখা

হরপ্পা সভ্যতা : হরপ্পা সভ্যতার নামকরণ ও সময়কাল, হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা, হরপ্পা সভ্যতার ব্যাপ্তি: আসসালামু আলাইকুম ভাই ও বোনেরা আপনারা কেমন আছেন? আশা করি ভালো আছেন, আমিও আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি, আপনাদের স্বাগতম জানাচ্ছি লাখ পড়া মাইমুনা তে। আমার নাম মাইমুনা, আজকে আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আপনাদের বিভিন্ন জায়গায় লাগতে পারে। 

আমি জানি আপনারা “হরপ্পা সভ্যতা : হরপ্পা সভ্যতার নামকরণ ও সময়কাল, হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা, হরপ্পা সভ্যতার ব্যাপ্তি” বিষয়ে ধারণা নিতে অনলাইনে খোজাখুঝি করছেন।আর আপনি এখন একদম সঠিক পোস্ট এ আছেন। এখানে আপনি এই বিষয়টি সম্পর্কে সব ভালো ভাবে জানতে পারবেন। 

হরপ্পা সভ্যতা : হরপ্পা সভ্যতার নামকরণ ও সময়কাল, হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা, হরপ্পা সভ্যতার ব্যাপ্তি - আসল ব্যাখা

হরপ্পা সভ্যতা : হরপ্পা সভ্যতার নামকরণ ও সময়কাল, হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা, হরপ্পা সভ্যতার ব্যাপ্তি

হরপ্পা সভ্যতা

বিংশ শতকের দু'য়ের দশকে ভারতীয় উপমহাদেশে বহু বিস্তৃত এক উন্নত নগর-সভ্যতার অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়। সিন্ধুনদ ও তার শাখা-প্রশাখা বিধৌত সমভূমি অঞ্চল হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়োতে এই প্রাচীনতম সভ্যতার প্রাথমিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহনী যথাক্রমে মহেঞ্ঝোদড়ো ও হরপ্পাতে এই দু'টি সভ্যতার সন্ধান পান। আবিষ্কৃত অবশেষের নিরিখে এই দুটি সভ্যতার জীবনধারা ও বস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে লক্ষণীয় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উত্তরভাগে অবস্থিত হরপ্পা নগরীটি পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলায় অবস্থিত। একদা এর পাশ দিয়ে রাভি নদী বয়ে যেত। অন্যদিকে দক্ষিণের নগরীর অবস্থান সিন্ধুপ্রদেশের অন্তর্গত লারকানা জেলায়। 

একদা এর পাশ দিয়ে সিন্ধুনদের প্রবাহ সজীব ছিল। এই যমজ নগরীর পারস্পরিক দূরত্ব প্রায় চারশ' মাইল। মহেঞ্ঝোদড়ো নগরীর আবিষ্কারের আগে ঐ অঞ্চল একটি অবহেলিত উঁচু ঢিবি হিসেবে পড়েছিল। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ ঢিবির তলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করলে ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় এক নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা (তাম্রশ্মীয়) সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা নাড়া খায়। এতকাল মনে করা হত যে, বৈদিক সভ্যতা থেকে ভারতে আদি সভ্যতার ইতিহাসের অনুসন্ধান করাই সঠিক। কিন্তু বিংশ শতকের গোড়ায় সেই ধারণা পরিত্যক্ত হবার সম্ভাবনা দৃঢ় হয়। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা স্যার জন মার্শাল এই খনন কার্যে বিশেষ উদ্যোগ নেন।


তাম্রপ্রস্তর বা ব্রোঞ্জ যুগের অপর দু'টি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যথাক্রমে নীলনদের তীরে মিশর (ফারাও) এবং ইউফ্রেটিস্ নদের তীরে মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাকের অংশকে কেন্দ্র করে। স্বভাবতই সিন্ধুর অববাহিকায় আবিষ্কৃত সভ্যতার সাথে সমকালীন এই দু'টি সভ্যতার সংযোগ খোঁজার প্রবণতা জন্মে। শেষ পর্যন্ত সীলমোহর, পুঁতি ইত্যাদি ছোট ছোট আবিষ্কারের আকৃতি প্রকৃতিগত মিল থেকে ভারতীয় সভ্যতার সাথে মিশর ও মেসোপটেমিয় সভ্যতার ঘনিষ্ঠ যোগের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহেঞ্জোদড়োর খননকার্যের পরে বিষয়টি গবেষকদের বিশেষভাবে আকর্ষিত করে। ফলে নতুন নতুন এলাকায় খননকার্য সম্পাদিত হতে থাকে। 

ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তঘেঁষা বিস্তৃত অঞ্চলে আবিষ্কৃত অবশেষসমূহ থেকে হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়োর অনুরূপ সভ্যতার সন্ধান সম্পর্কে প্রত্নবিদরা নিশ্চিত হয়েছেন। ভারতে দীর্ঘকাল প্রচলিত এবং ধ্বংসের পর দীর্ঘকাল অনাবিষ্কৃত এই সভ্যতার প্রকাশ গবেষকদের অনুসন্ধিৎসা ক্রমশ বৃদ্ধি করে চলেছে। উঠে আসছে নতুন নতুন তথ্য। 

তবে সাংকেতিক লিপির অস্তিত্ব আবিষ্কার হলেও, তার পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি। ফলে তথ্যানুসন্ধানের কাজ যেমন কিছুটা কঠিন হয়েছে, তেমনি বিতর্কের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিতর্ক আছে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। সভ্যতার নামকরণ, প্রাচীনত্ব, বৈশিষ্ট্য, পতনের কারণ—ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের মতান্তর এই প্রাচীনতম সভ্যতার পঠন-পাঠনকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

হরপ্পা সভ্যতার ব্যাপ্তি :

হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়োকে কেন্দ্র করে ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতার অস্তিত্ব জানা গেলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সভ্যতার বিস্তার ও ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কিত ধারণা পাল্টে গেছে। স্যার জন মার্শাল প্রথমেই সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, এত উন্নত একটা সভ্যতা কেবল হরপ্পা মহেঞ্জোদড়োর ছোট্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। পরবর্তীকালে মার্টিনার হুইলার অনেকগুলি নতুন প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কার করেন। 

গর্ডন চাইল্ড দৃঢ়তার সাথে জানান যে (১৯৫৪ খ্রিঃ) বর্তমান সীমারেখার বাইরেও হরপ্পা সভ্যতার রেশ সম্প্রসারিত হয়েছিল। সমকালীন মিশর বা মেসোপটেমিয় সভ্যতার থেকে সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপ্তি বেশী ছিল। নতুন উৎখনন করা প্রত্নক্ষেত্র এবং আবিষ্কৃত পুরাবস্তুসমূহের চরিত্র বিশ্লেষণ করে মোটামুটিভাবে প্রায় পাঁচ লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে এই সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমিত হয়। 

ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, সিন্ধু, গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এবং পাকিস্তানের অন্তর্গত বালুচিস্তান ও আফগানিস্তানের শোর্টুগাই থেকে দেড় হাজারেরও বেশী প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। অবশ্য এদের অধিকাংশই পরিণত সভ্যতার অধিকারী ছিল না এবং মাত্র ছয়টি প্রত্নক্ষেত্র উন্নত নাগরিক সভ্যতার সাক্ষী ছিল।


দয়ারাম সাহানীর উদ্যোগে হরপ্পাতে সর্বপ্রথম উৎখনন শুরু হয়। তবে প্রায় একশো বছর আগেই হরপ্পার রহস্য প্রত্নতাত্ত্বিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চার্লস ম্যাসন প্রথম হরপ্পা ঢিবির কথা উত্থাপন করেন (১৮২৬ খ্রিঃ)। 

এর প্রায় তিন দশক কাল পরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা আলেকজাণ্ডার কানিংহাম হরপ্পা পরিদর্শন করে (১৮৫৩-৭৩ খ্রিঃ) কয়েকটি সিলমোহর উদ্ধার করেন। তবে এই প্রত্নক্ষেত্রের অন্দরে যে বিপুল রহস্য লুকিয়ে আছে, তা তিনি অনুধাবন করতে পারেননি। পরে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে দয়ারাম সাহানী সেই রহস্য উন্মোচন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে এম. এস. ভাট, স্যার মার্টিমার হুইলার প্রমুখ খননকার্য চালিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার করেন। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটি হল সিন্ধুনদের তীরে অবস্থিত মহেঞ্জোদড়ো। 

তৃতীয় কেন্দ্রটি হল মহেঞ্জোদড়ো থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত চানহৃদাড়ো। এছাড়া গুজরাটের ক্যাম্বে প্রণালীর মুখে লোথাল আর কচ্ছের রান এলাকায় ধোলাবিরাতে দু'টি সমধর্মী প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। পরিণত পর্বের হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে উত্তর-রাজস্থানের শুকিয়ে যাওয়া ঘর্ঘরা নদীর তীরবর্তী কালিবনগানে এবং হরিয়ানার হিসা জেলার বানওয়ালিতে। এছাড়া হরিয়ানার রাখিগড়ি, গুজরাটের সুরকোটাডা, রংপুর (কাথিয়াবাড়ের নিকট) এবং রোজদি'তে এই সভ্যতার প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। পাকিস্তানের অন্তর্গত বালুচিস্তানে আছে দু'টি প্রত্নক্ষেত্র সুৎকাজেনদোর ও সোংকা-কোহ।


সিন্ধুর অববাহিকা ছাড়িয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় হরপ্পা সভ্যতার ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি আজ স্বীকৃত। রণবীর চক্রবর্তীর মতে, এই বিশাল এলাকায় সভ্যতার প্রসার ঘটেছিল তার পরিণত ও বিকশিত পর্যায়ে। এর সম্ভাব্য সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ থেকে ১৮০০ অব্দ জুড়ে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে এই সভ্যতার আরো কিছু কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। সাধারণভাবে হরপ্পা সভ্যতার প্রসারিত এলাকার চতুঃসীমা এইভাবে নির্ণয় করা যায়। পূর্বদিকে বর্তমান দিল্লীর পূর্ব-প্রান্তে গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চলে অবস্থিত আলমগীরপুর, পশ্চিমদিকে বর্তমান পাকিস্তানের মাকরান উপকূলের সুৎকাজেনদোর, উত্তর-মুখে আফগানিস্তানের শোর্টুগাই এবং দক্ষিণপ্রান্তে গুজরাট ও কচ্ছের রান এলাকাসহ মহারাষ্ট্রের দৈমাবাদ অঞ্চল।

হরপ্পা সভ্যতার নামকরণ :

ভারতে তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের এই উন্নত সভ্যতার প্রধান দুটি কেন্দ্র হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়োতে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তাই সমকালীন সভ্যতার নামকরণের দৃষ্টান্ত অনুসরণে এটিকে 'সিন্ধুসভ্যতা' নামে অভিহিত করা শুরু হয় (নীলনদের তীরবর্তী মিশরের 'নীলনদের সভ্যতা' নামানুসারে, সিন্ধুনদের উপত্যকায় অবস্থিত হরপ্পা-মহেঞ্ঝোদড়োর সভ্যতাকে 'সিন্ধু-সভ্যতা' নাম দেওয়া হয়)। 

কিন্তু পরবর্তীকালের খননকার্য থেকে বোঝা যায় যে এই সভ্যতা কেবল সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। পূর্বে আলমগিরপুর থেকে পশ্চিমে মাকরান উপকূল এবং উত্তরে আফগানিস্তানের সোটু গাই থেকে দক্ষিণে গোদাবরী উপত্যকার দৈমাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হলে এটিকে অঞ্চলভিত্তিক নামকরণের যৌক্তিকতা দুর্বল প্রতিপন্ন হয়। ফলে শুরু হয় নতুন নামকরণের প্রয়াস। প্রত্নতত্ত্বের একটা প্রচলিত রীতি হল যে, একটি সভ্যতার নিদর্শন প্রথম যে অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়, সেই অঞ্চলের নামানুসারে সভ্যতাটির নামকরণ করা হয়। দয়ারাম সাহানী বিংশ শতকের গোড়াতেই হরপ্পাতে একটি প্রণালীবদ্ধ খননকার্যের সূচনা করেন। 

অতঃপর মহেঞ্জোদড়োসহ ভারত ও পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অংশে তাম্র-ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এই সকল কেন্দ্রের উদ্ধার করা প্রত্নসামগ্রীর সাথে হরপ্পার প্রত্নবস্তুর মিল দেখা যায়। তাই যে সকল অঞ্চলে হরপ্পা এলাকার সমবৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, তাদের একত্রে 'হরপ্পা সভ্যতা' নামকরণ করা যুক্তিযুক্ত। শিরিন রত্নাগর-এর মতে, 'হরপ্পা সভ্যতা' বা ‘হরপ্পীয়' নামটি সবদিক থেকে সন্তোষজনক নামাঙ্কন।


হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়ো সভ্যতার নামকরণ প্রসঙ্গে এক নতুন বিতর্ক তৈরী করেছেন হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসবিদ নটবর ঝা, রাজারাম প্রমুখ। এঁদের মতে, এই প্রাচীনতম সভ্যতার উৎসস্থল হল সরস্বতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল। তাই একে 'সরস্বতী সভ্যতা' বলা সঠিক। এঁদের বক্তব্যের ভিত্তি হল বৈদিক সাহিত্যে সরস্বতী নামক একটি নদীর উল্লেখ। বলা হয়েছে যে, এই নদীটি উত্তর-পূর্বে সৃষ্টি হয়ে হরিয়ানা, উত্তর-রাজস্থান স্পর্শ করে নিম্ন সিন্ধু এলাকা পর্যন্ত প্রবাহিত ছিল। রাজস্থানের ‘ঘগ্নর' এবং পাকিস্তানের আরো নিচু এলাকা চোলিস্তানের 'হাক্রা' নামক শুষ্ক একটি নদীখাতকে সরস্বতীর প্রবাহরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ পণ্ডিত এই বক্তব্য মানতে অস্বীকার করেছেন। বিরোধীদের মতে, 

(১) সরস্বতী নদীর নামোল্লেখ প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে (ছান্দম) পাওয়া যায়। কিন্তু এর অস্তিত্ব যথেষ্ট প্রমাণিত হয়নি। আসলে 'সরস্বতী' একটি গুনবাচক শব্দ, কোনো নদীর নাম নয়। 

২) ঘগর-হাক্রার স্রোতধারাটি সিন্ধুনদের উপনদী ছিল, একে স্বতন্ত্র্য নদী বলা সঠিক হবে না। শিরিন রত্নাগরের মন্তব্য, 'সরস্বতী এই শব্দটি বৈদিক সাহিত্যে প্রতিফলিত সংস্কৃতি আর মাটি-খুঁড়ে পাওয়া হরপ্পা সভ্যতার অঞ্চলের মধ্যে কেবল এক ধরনের অভিন্নতার চমক আনে, যদিও প্রকৃতক্ষেত্রে এদের মধ্যে কোন মিল নেই।' কিন্তু এখনও হরিয়ানাতে ‘সরসূতি’ (Sarsuti) নামে একটি নাতিদীর্ঘ নদীর অস্তিত্ব আছে। এটি কিছু এগিয়ে রাজস্থানের প্রবেশের আগে ‘দৃষদ্বতী' (Drisadwati) নামক অন্য একটি নদীখাতের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। এটিই যদি ‘ঘগ্নর ও হাক্রা’' হয়, তাহলে হরপ্পা সভ্যতার সাথে সরস্বতীর যোগ একেবারে অস্বীকার করা যায় না। 

'জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া'-এর ১৯৬৪ থেকে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত পাঁচটি প্রতিবেদনেই ঘগ্নর-হাক্রা বেড-কে প্রাচীন সরস্বতীর প্রবাহ বলা হয়েছে। এর ভিত্তিতে অধ্যাপিকা অরুনিমা রায়চৌধুরী তাঁর ‘প্রাগৈতিহাসিক ভারতবর্ষ' শীর্ষক পুস্তকে লিখেছেন যে, সিন্ধুসভ্যতার মূল উৎসস্থল হিসেবে সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলের পরিবর্তে সরস্বতী-দৃষদ্বতী অববাহিকার চোলিস্তান মরু অঞ্চলকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের রীতি অনুযায়ী এই সভ্যতাকে প্রথম উৎখননস্থলের ভিত্তিতে 'হরপ্পা-সভ্যতা' বলা অধিকতর যুক্তিসিদ্ধ।

হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল :

হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল নির্ণয়ের কাজটি বেশ কঠিন। খননকার্যের ফলে বহু সীলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলিতে খোদিত লিপিগুলির সঠিক পাঠোদ্ধার করা এখনো পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এগুলির অর্থ উদ্ধার করতে পারলে হয়তো হরপ্পা-সভ্যতার কালনির্ণয় সম্ভব হবে। যাইহোক, খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতগণ এই সভ্যতার সময়কাল নির্ণয়ে সচেষ্ট হয়েছেন। হরপ্পা-সভ্যতার নিম্নতম কালসীমা নির্ণয়ে অসুবিধা কিছুটা কম। কারণ যেহেতু এই সভ্যতার কোনো কেন্দ্রে লোহার কোনো দ্রব্য পাওয়া যায়নি, তাই মনে করা যায় লৌহযুগ শুরু হবার আগেই সভ্যতাটির বিনাশ ঘটেছিল। পণ্ডিতদের অনুমান খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দেরও আগে লৌহযুগের সূচনা হয়েছিল। তাই এই তারিখটিকে হরপ্পা-সভ্যতার নিম্নতম কালসীমা ধরা যেতে পারে। হরপ্পা-সভ্যতার সীলমোহরের অনুরূপ কিছু সীলমোহর মেসোপটেমিয়া, এলাম, ব্যাবিলন প্রভৃতি স্থানে পাওয়া গেছে। এগুলির আকৃতিগত সাদৃশ্য বিচার করে ড. গ্যাড সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা নির্ণয় করেছেন ২৫০০-১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে। জন মার্শালের মতে, এই সভ্যতার সময়কাল ছিল ৩২৫০ থেকে ২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী কোনো সময়। তেল আসরামে প্রাপ্ত সিন্ধু-সভ্যতার সীলের ভিত্তিতে ড. ফ্রাঙ্কফুট ২৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দকে এই সভ্যতার 'বিকাশকাল' বলে নির্দেশ করেছেন। এখন যদি ধরা যায় সিন্ধু সভ্যতা অন্তত ৫০০ বছর ভ্রুণ অবস্থায় ছিল, তাহলে ২৮০০ + ৫০০ = ৩৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই সভ্যতার সূচনা হয়েছিল বলা চলে। মার্টিমার হুইলার সংস্কৃতির সময়কাল হিসেবে ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দকে গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু এই হাজার বছর সময়সীমাকে অনেকে অবাস্তব বলে মনে করেন। ড. রামশরণ শর্মার মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ১৭৫০ অব্দ পর্যন্ত হরপ্পা-সভ্যতা স্থায়ী হয়েছিল। তাঁর মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দ নাগাদ সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়ো ধ্বংস হয়েছিল। তবে অন্যান্য স্থানে অবক্ষয় এসেছিল পরবর্তীকালে। রেডিও কার্বন-পদ্ধতিতে প্রাপ্ত তারিখগুলি হরপ্পা-সভ্যতার সময়কাল নির্ধারণে বিশেষভাবে সাহায্য করে। 'টাটা ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চের' ড. অগ্রবাল প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পরীক্ষার পর বলেছেন, “সিন্ধু-সভ্যতার ঊর্ধ্বতম কালসীমা চতুর্বিংশ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে টেনে নিয়ে যাবার কোনো দরকার নেই।” মেসোপটেমিয়ায় প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে মি. বুকানন মন্তব্য করেছেন হরপ্পা-সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের জন্য খ্রিষ্টপূর্ব ত্রি-বিংশ শতাব্দী অতিক্রম করে পিছিয়ে যাবার দরকার নেই। তাঁর মতে, এই সভ্যতার পরিণত পর্ব তিনশত বছরের অধিক স্থায়ী ছিল না। সুতরাং এ কথা বিশ্বাস করা যায় যে, এই সভ্যতার পরিণত পর্ব ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে শেষ হয়েছিল। হরপ্পা ও চানহৃদড়োতে প্রাপ্ত ‘বিস্তৃতপক্ষ ঈগল' সীলের সাথে ২৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিউসায় প্রাপ্ত সীলের সামঞ্জস্য এই মতকে সমর্থন করে। মোটামুটিভাবে বলা যায়, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় সিন্ধু-সভ্যতার সীলের অনুরূপ যে সীল পাওয়া গেছে, তাদের অধিকাংশই ইসিন যুগ ও লারসা যুগের সাল সম্পর্কিত। তাহলে ধরা যেতে পারে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দের মধ্যে সিন্ধু-মেসেপটেমিয়া সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। হরপ্পা-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র কালিবনগান, লোথাল, রোজদি প্রভৃতি স্থানের প্রাথমিক স্তরগুলির কার্বন-১৪ পদ্ধতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে যে, তা খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাবিংশ শতাব্দী এবং সর্বশেষ স্তরগুলি খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তদশ শতাব্দীর পুরানো। এই রেডিও কার্বন পদ্ধতি সর্বাধিক বিশ্বাসযোগ্য, কারণ এটি অনুমানভিত্তিক নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক।

হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা :

হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু-সভ্যতার স্রষ্টা কারা ছিলেন, এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, বৈদিক আর্যজাতি হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা। এই মতের সপক্ষে তাঁরা বলেন যে হরপ্পা-সভ্যতায় প্রাপ্ত কঙ্কালগুলির মধ্যে আর্যজাতির মানুষেরও কঙ্কাল রয়েছে। তাছাড়া সিন্ধুবাসী ও আর্যদের পোশাক ও খাদ্যের মধ্যেও যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। এই মতের সমর্থকগণের মতে, আর্যরা বহিরাগত কোন জাতি ছিল না। ভারতবর্ষই ছিল তাদের আদি বাসস্থান। তা যদি হয় তাহলে হরপ্পা-সভ্যতাও তাদেরই সৃষ্ট বলে মেনে নিতে হয়। কিন্তু ব্যাসাম-সহ বহু পণ্ডিত যুক্তি দ্বারা এই মত খণ্ডন করেছেন। এঁদের মতে, আর্যরা যদি হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা হয়ে থাকেন তবে ধরে নিতে হবে যে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের আগে থেকেই তারা ভারতে ছিলেন। কিন্তু ১৫০০ ১৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আগে ভারতে বৈদিক সভ্যতার অবস্থিতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই আর্যগণকে হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা বলে মেনে নেওয়া যায় না। তা ছাড়া আর্য-সভ্যতা ছিল মূলত গ্রামীণ। কিন্তু সিন্ধু-সভ্যতা ছিল নগরভিত্তিক। এমনকি ধাতু ব্যবহারের ক্ষেত্রেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল। যেমন হরপ্পায় লৌহের প্রচলন ছিল না। কিন্তু আর্যরা লোহার ব্যবহার জানত। ধর্মবিশ্বাস ও জীবিকার দিক থেকেও উভয় সভ্যতার যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। উভয়ের মৃৎপাত্র ছিল আলাদা ধরনের। তাই মার্শাল মন্তব্য করেছেন যে, “বৈদিক সভ্যতা সিন্ধু-সভ্যতা অপেক্ষা কেবল পরবর্তীই নয়, সম্পূর্ণ বিজাতীয় ও স্বতন্ত্রও বটে।”


অপর একদল পণ্ডিত সুমেরীয়দের ‘হরপ্পার স্রষ্টা' বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। সুমেরীয়সভ্যতা ও হরপ্পা-সংস্কৃতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য থেকেই এঁরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। দুটি সভ্যতাই ছিল নদীমাতৃক। একটি গড়ে উঠেছিল টাইগ্রীস-ইউফ্রেটিস নদীর উপকূলে, অন্যটির বিকাশ ঘটেছিল সিন্ধুনদের বিস্তীর্ণ অববাহিকায়। উভয় সভ্যতার মানুষের কাছেই মাতৃপূজা যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। বাড়ি তৈরির জন্য সুমেরু ও হরপ্পা-উভয় সভ্যতাতেই পোড়া ইট ব্যবহৃত হত এবং পয়ঃপ্রণালী ছিল উন্নত। গৃহনির্মাণ-পদ্ধতির ক্ষেত্রেও উভয়ের যথেষ্ট সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। সুমেরুর সুপ্রাচীন লেখ ও প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে জানা যায় যে,উর-এ বিশাল শস্যাগার ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়োতেও একইপ্রকার শস্যাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। উভয় সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল তাম্রযুগে। এইসব সাদৃশ্যের ভিত্তিতেই সুমেরীয়-সভ্যতা থেকেই হরপ্পা-সভ্যতার সৃষ্টির সপক্ষে হুইলার মতপ্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, হরপ্পা-সংস্কৃতি সুমেরু-সভ্যতার কাছে ঋণী ছিল, এমনকি সুমেরীয় সভ্যতাই সিন্ধু অববাহিকায় স্থানান্তরিত হয়েছিলে বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, এই সভ্যতা বিদেশাগত ছিল বলেই এটি উত্তর-পশ্চিম ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল, ভারতের অভ্যন্তর ভাগে বিস্তৃত হয়নি। তবে এই মতের বিপক্ষেও বহু যুক্তি উপস্থাপিত করা যায়। কারণ উভয় সভ্যতার মধ্যে কিছু আপাত সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্যের অভাব ছিল না এবং বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ে উভয়ের পার্থক্য ছিল। যেমন—লিপি, সীলমোহর, মৃৎপাত্র ইত্যাদি সকল কিছুর মধ্যেই যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য বর্তমান ছিল। উভয় সভ্যতাই ছিল স্থানীয় ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ। উভয়ের মধ্যে যে আপাত সাদৃশ্যগুলি দেখা যায়, সমকালীন সভ্যতা হিসেবে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমেই তা গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। তাই ব্যাসাম, মার্শাল প্রমুখ ‘সুমেরু সভ্যতা থেকে হরপ্পা-সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল' এই মতের ঘোরতর বিরোধিতা করেছেন। শেষ পর্যন্ত হুইলারও হরপ্পা-সভ্যতার মৌলিকত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন।


কেউ কেউ আবার ব্রাহুই উপজাতির লোকেদের হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা বলে মনে করে থাকেন। তাঁদের মতের সমর্থনে তাঁরা এই যুক্তি উপস্থাপিত করেন যে, বালুচিস্তানে বসবাসকারী ব্রাহুই উপজাতি এখনো দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলে। ব্রাহুই ছাড়াও অসুর, নাগ, পণি প্রভৃতি জাতিকেও হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা বলে অনেকে মতপ্রকাশ করেছেন।


অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, দ্রাবিড়জাতি হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা। এরা যুক্তি হিসেবে বলেছেন, প্রাক্‌-আর্য যুগে দ্রাবিড়জাতি সমগ্র ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতেও তাদের বিস্তৃতি ছিল ধরা যেতে পারে। বিশেষত বর্তমানেও বালুচিস্তানের ব্রাহুই উপজাতির মধ্যে কথ্যভাষা হিসেবে দ্রাবিড় ভাষার অস্তিত্ব উত্তর-পশ্চিম ভারতের দ্রাবিড় সংস্কৃতির বিস্তারের প্রমাণ বহন করে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে মোঙ্গলীয় ও আল্পীয় জাতির মিশ্রণ দেখা যায়। হরপ্পা-সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকেও বা কবর স্থানগুলি থেকেও এইরূপে শারীরিক গঠন-সম্পন্ন মানুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক ফিলিওজা বলেছেন যে, আর্য-পূর্ব ভারতীয় জনগণের মধ্যে দ্রাবিড় ও মুণ্ডাই ছিল প্রধান। মুণ্ডারা ছিল অসংস্কৃত, কিন্তু দ্রাবিড়রা ছিল উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী। এদিকে হরপ্পা-সংস্কৃতিও ছিল উন্নত। তাই এর স্রষ্টা হিসেবে দ্রাবিড়দের সনাক্ত করলে অযৌক্তিক হবে না। চতুর্থত, ধর্মগত বিষয়েও এই দুই সভ্যতার মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। শিবপূজা ও লিঙ্গপূজা উভয় সংস্কৃতিরই অঙ্গ ছিল। পঞ্চমত, বিখ্যাত লিপি বিশারদ ফাদার হোরেস-এর মতে, হরপ্পালিপি প্রাচীন তামিল লিপির আদিরূপ। ষষ্ঠত, ঋগ্বেদ অনুযায়ী অনার্যদের সাথে যুদ্ধ করে বা তাদের পরাস্ত করে আর্যরা তাদের সভ্যতা বিস্তার করেছিল। দ্রাবিড়গণও ছিল অনার্য। এইসব যুক্তির ভিত্তিতে কিছু ঐতিহাসিক দ্রাবিড়গণকেই হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টার মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু এই মতের বিরুদ্ধেও বহু যুক্তি উপস্থাপিত করা যায়। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে আসে তা হল দ্রাবিড়জাতি দক্ষিণ ভারতের একটি সভ্যতার ধারক ও বাহক। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতে সিন্ধুর নগরের অনুরূপ কোন নগর প্রতিষ্ঠা করাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ঐরূপ কোন নিদর্শন এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। দ্বিতীয়ত, ব্রাহুই জাতির মানুষেরা অন্যান্য দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও তারা তুর্কো-ইরানীর জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তৃতীয়ত, উভয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পদ্ধতি এক নয়। দ্রাবিড়গণ মৃতদেহ সমাহিত করত কিন্তু সিন্ধু উপত্যকা খনন করে সমাধির পাশাপাশি শবদাহের প্রমাণও পাওয়া গেছে। চতুর্থত, প্রাচীন তামিল লিপির সাথে হরপ্পা লিপির সাদৃশ্যের বিষয়টি এখনো গবেষণা স্তরেই রয়ে গেছে। কারণ হরপ্পা লিপির পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি। তাই দ্রাবিড়গণই সিন্ধু-সভ্যতার স্রষ্টা ছিল এরূপ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।


উপরেরআলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা কারা, এ সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া এখনো সম্ভব হয়নি। তবে সিন্ধু উপত্যকার ধ্বংসাবশেষ বা সমাধিক্ষেত্রগুলি থেকে প্রাপ্ত কঙ্কালের মাথার খুলি, অস্থি ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে নৃতাত্ত্বিকগণ এই ধারণায় পৌঁছেছেন যে, উক্ত অঞ্চলে চারপ্রকার মানুষের বসবাস ছিল। এরা হল ককেশীয়, ভূমধ্যসাগরীয়, আলপীয় ও মোঙ্গলীয়। এর মধ্যে মহেঞ্জোদড়োতে ভূমধ্যসাগরীয় ধরনের মানুষ বেশি বাস করত। হরপ্পা সভ্যতার প্রাপ্ত ভূমধ্যসাগরীয় ধরনের মানুষের মাথার খুলির সাথে মেসোপটেমিয়া ও তুর্কীস্থানে প্রাপ্ত খুলির মিল দেখা যায়। আবার মেসোপটেমিয়ার 'কিশ্' নামক স্থানে প্রাপ্ত খুলির সাথে হরপ্পা সভ্যতার আলপীয় ধরনের খুলি সাদৃশ্যযুক্ত। এ থেকে অনুমিত হয় যে, বিভিন্ন জাতির লোকের সংমিশ্রণে হরপ্পা-সংস্কৃতির সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছিল। অবশ্য অধুনা নৃতাত্ত্বিক ডঃ ডি. কে. সেন এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, হরপ্পা-সভ্যতার নগরগুলিতে একটিই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করত। এরা ছিল মাঝারি উচ্চতা, চওড়া নাক ও উঁচু মাথার খুলিবিশিষ্ট। তাঁর মতে, এখানকার আদিম অধিবাসীদের বংশধর এই মানুষরাই এখানে বসবাস করত ও এই সভ্যতা সৃষ্টি করেছিল। আবার এমনও হতে পারে, হরপ্পা সভ্যতার আদি বিকাশকেন্দ্র এখনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে। বিশেষত মহেঞ্জোদড়োর নিম্নের কয়েকটি স্তর জলমগ্ন থাকায় এ বিষয়ে গবেষণার অবকাশ থেকে যায়। গর্ডন চাইল্ডের মতে, আমরা হরপ্পা সভ্যতার পরিণত নাগরিক রূপটি প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু এর আগে বেশ কিছু সময় ধরে এই সভ্যতা ভ্রুণ অবস্থায় ছিল। তখন হয়তো একটি গ্রামীণ-সভ্যতা ছিল। পরে সেটিই বিবর্তিত হয়ে উন্নত নগর-সভ্যতার রূপ নেয়।

হরপ্পীয় সীলমোহর

হরপ্পা সংস্কৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে সীলমোহরগুলির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদের অধিকাংশই ‘স্টিয়াটাইট' জাতীয় পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। এটি এক ধরনের নরম পাথর, যা সহজে কাটা যায় এবং প্রয়োজনমত মসৃণ করা যায়। নরম হওয়ার কারণে স্টিয়াটাইট পাথরে খোদাই করার কাজও সহজ হত। এছাড়া পোড়ামাটি বা হাতির দাঁতের তৈরি সীলও পাওয়া যায়। এদের গড়ন মুলত চতুষ্কোণাকৃতি। আয়তাকার সীলও কিছু দেখা যায়। সীলের একদিক মসৃণ করে উল্টানো অবস্থায় কোন আকৃতি বা সাংকেতিক লিপি খোদাই করা হত। যে-কোন নরম বস্তুর উপর, যেমন কাদামাটি, সীলের ছাপ দিলে একটি সোজা প্রতিকৃতি বা লিপি ভেসে ওঠে।


সীলগুলি তৈরির পদ্ধতি ছিল সুন্দর। প্রথমে ছুরি, করাত, তুরপুন এবং খোদাইকারীর সাহায্যে সীলটিকে কেটে, ঘষে তার উপর খোদাই কাজ সম্পাদন করা হত। শিরিন রত্নাগর-এর লেখা থেকে দেখা যায় যে, হরপ্পীয়রা সীল তৈরির পর এক ধরনের সাদাবস্তু মাখিয়ে সেগুলিকে পুড়িয়ে নিত। এর ফলে কাঠিন্যের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যেত। পোড়ামাটির সীলের পেছন দিকে কাপড় কিংবা সুতা বা গিঁটের স্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। সীলগুলিতে যে সকল পশুমূর্তি দেখা যায়, তাদের মধ্যে প্রধান ছিল এক শৃঙ্গযুক্ত গণ্ডার, হাতি, বৃষ, বাঘ, ঘড়িয়াল ও হরিণ। অধিকাংশ সীলে ‘ইউনিকর্ণ” জাতীয় একটি পৌরাণিক জন্তু আছে। এটি আসলে অনেকগুলি পশুর সমন্বিত রূপ। তিন শিংযুক্ত যোগাসনে উপবিষ্ট দেবমূর্তির সীলটি গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকটিতে জ্যামিতিক নকশার ছবি দেখা যায়। বর্গাকার বা আয়তাকার ফলকে পশু বা মনুষ্যমূর্তি উৎকীর্ণ থাকত। সম্ভবত এগুলি তাবিজ-কবচ হিসেবে কব্জিতে ধারণ করা যেত। সীলমোহরের ওপর খোদিত লিপি খুবই সংক্ষিপ্ত। পাঁচ-ছটি সাংকেতিক চিহ্নে এগুলি সীমাবদ্ধ। সম্ভবত মালিকের নাম, পদ ছাড়া বিশেষ কিছু এখান থেকে জানা যায় না।


সীলগুলিতে প্রাপ্ত পশু-পাখির প্রতিকৃতি থেকে অনুমিত হয় যে, সেকালে পশুপূজা প্রচলিত ছিল। একটি সীলে দীর্ঘ কেশযুক্ত, ত্রিশূল-শৃঙ্গ সমন্বিত এক নগ্ন দেবতার মূর্তি দেখা যায়। কয়েকটি সীলে রেলিংদ্বারা বেষ্টিত বৃক্ষ ও বেদী দেখা যায়। সম্ভবত তখন অগ্নির উপাসনা প্রচলিত ছিল। ড. রণবীর চক্রবর্তী লিখেছেন, "হরপ্পার সীলমোহরগুলি অবশ্যই লেনদেন প্রক্রিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। পণ্যের ওজন, মূল্য ও গুণমান যে উন্নত ও নির্ধারিত সে বিষয় সুনিশ্চিত করার জন্য সীলগুলি প্রয়োগ করা হত। হরপ্পীয়দের আমলে ভারতের জলপথ-বাণিজ্য এবং বিদেশের সাথে যোগাযোগের প্রমাণস্বরূপ সীলমোহরের সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ। হরপ্পার কয়েকটি সীলে জলযানের প্রতিকৃতি খোদাই ছিল, যা সমুদ্র বাণিজ্যের সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। মেসোপটেমিয়াতে হরপ্পার সীলের অনুরূপ প্রায় তেইশটি সীল পাওয়া গেছে।” গবেষক জে. সি. গ্যাড্ এই আবিষ্কারের ভিত্তিতে অনুমান করেছেন যে, হরপ্পার সাথে মেসোপটেমিয়ার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যসম্পর্ক ছিল।

আশা করি আমার ভাই বোনের এই পোস্টটি অনেক ভালো লেগেছে। এর সাথে হরপ্পা সভ্যতা : হরপ্পা সভ্যতার নামকরণ ও সময়কাল, হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা, হরপ্পা সভ্যতার ব্যাপ্তি বিষয়টিও তোমরা বুঝতে পেরেছ। যদি এই পোস্টটি থেকে কিছু উপকার পাও, তাহলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে কখনো ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন