সুলতানি আমলে নগরের বিকাশ | মধ্যযুগের ভারতে নগরের বিকাশ - আসল ব্যাখা

সুলতানি আমলে নগরের বিকাশ,মধ্যযুগের ভারতে নগরের বিকাশ: আসসালামু আলাইকুম ভাই ও বোনেরা আপনারা কেমন আছেন? আশা করি ভালো আছেন, আমিও আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি, আপনাদের স্বাগতম জানাচ্ছি লাখ পড়া মাইমুনা তে। আমার নাম মাইমুনা, আজকে আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আপনাদের বিভিন্ন জায়গায় লাগতে পারে। 

আমি জানি আপনারা “সুলতানি আমলে নগরের বিকাশ,মধ্যযুগের ভারতে নগরের বিকাশ” বিষয়ে ধারণা নিতে অনলাইনে খোজাখুঝি করছেন।আর আপনি এখন একদম সঠিক পোস্ট এ আছেন। এখানে আপনি এই বিষয়টি সম্পর্কে সব ভালো ভাবে জানতে পারবেন। 

সুলতানি আমলে নগরের বিকাশ | মধ্যযুগের ভারতে নগরের বিকাশ

সুলতানি আমলে নগরের বিকাশ,মধ্যযুগের ভারতে নগরের বিকাশ

সুলতানি আমলে নগরের বিকাশ :

ভারতে নগরায়ণ ও নগর-সভ্যতার ইতিহাস খুবই প্রাচীন, তবে ভারতে নগর-বিকাশের ইতিহাস ধারাবাহিক নয়। পশ্চিমি লেখকরা ভারতীয় শহরের চরিত্রকে গ্রামীণ সভ্যতা বলেই চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই বক্তব্য ঘটনার সঠিক প্রকাশ নয়। ড. অনিরুদ্ধ রায় লিখেছেন যে, বর্তমানে ভারতে পাঁচ হাজার জনসমষ্টি-সমন্বিত বারো হাজারেরও বেশি শহর আছে। এই বিচারে ভারতীয় সভ্যতাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো শহরাশ্রয়ী সভ্যতা বলা যায়। আমরা আগেই দেখেছি যে, ভারতে শহর তৈরি শুরু হয়েছিল হরপ্পা সংস্কৃতির যুগে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৩৫০ থেকে ১৭৫০ অব্দের মধ্যে এই নগরায়ণের সূচনা, বিকাশ ও অবক্ষয় ঘটেছিল। 

দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণ ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। খ্রিস্টীয় ৩০০ অব্দ পর্যন্ত এই পর্বের শহরগুলি টিকেছিল। গুপ্তযুগের পরবর্তীকালে এই পর্বের শহরগুলি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। 

অধ্যাপক রামশরণ শর্মা, বি. এন. এস. যাদব প্রমুখের মতে, ভারতে তৃতীয় পর্বের নগরায়ণ ঘটে ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে। কিন্তু ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, ৩০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে ভারতে নগরের অবক্ষয় সার্বিক ছিল না। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, আদি-মধ্যকালীন ভারতেও (আনুমানিক ৬৫০-১২০০ খ্রিঃ) নগরের অস্তিত্ব ছিল। বাণিজ্যকেন্দ্রিক কিছু নতুন শহরও গড়ে উঠেছিল। তিনি তাকেই ‘তৃতীয় পর্বের নগরায়ণ' (Third urbanization) বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য তিনিও স্বীকার করেছেন যে, মুসলমান শাসনের সূচনার পর অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতকে ভারতে নগরায়ণে আবার জোয়ার আসে।




ঐতিহাসিক এলিয়ট, লালনজী গোপাল, কে. লাল প্রমুখ মনে করেন যে, ভারতে মুসলমান শাসনের ফলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে এবং ভারতবর্ষ একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। কিন্তু অধ্যাপক মহম্মদ হাবিব ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এলিয়ট ও ডাউসনের 'হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইট্স ওন্ হিস্টোরিয়ান্‌স' গ্রন্থের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, মুসলমানদের আগমনের ফলে ভারতে পূর্বাপেক্ষা উন্নত এক সামাজিক শক্তির বিকাশ ঘটে। ভারতের অর্থনৈতিক সংগঠন উন্নততর হয় এবং ব্যাপক নগরায়ণ ঘটে। 

তিনি বলেন যে, মুসলমানদের আসার পরে যে ইতা প্রথার শুরু হয়েছিল, তা ছিল শহরভিত্তিক। 

ইক্তাদারদের বিরাট সেনাবাহিনীর জন্য কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল, এবং নতুন নগরগুলির চাহিদা নগরায়ণের পথ প্রশস্ত করেছিল। অধ্যাপক হাবিবের মতে, ভারতে মুসলমানদের আগমনের সূত্রে ‘দ্বিতীয় নগর-বিপ্লবের সূচনা হয়। 

এই নগর-বিপ্লবে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল বিদেশ থেকে আসা কারিগররা। উপরন্তু, সামাজিক বৈষম্য এড়াতে ও আর্থিক লাভের আশায় বহু হিন্দু কারিগর এই সময় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে শহরে অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত করে।


পরবর্তীকালে অধ্যাপক ইরফান হাবিব এই মতের আংশিক পরিবর্তন করেন। তিনি বলেন যে, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ভারতীয় অর্থনীতির পরিবর্তনগুলিকে আধুনিক অর্থে 'সামাজিক-বিপ্লব' বলা কিছুটা অতিকথন, যদিও ভারতীয় অর্থনীতির পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন যথার্থ। অধ্যাপক ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন যে, শাসকশ্রেণির শোষণের ফলে নতুনভাবে কৃষি-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। 

এর ফলে পরগাছার মতো নতুন শহরের জন্ম হয় যেখানে শাসকশ্রেণি তাদের সেনাবাহিনী ও অনুচরদের মধ্যে উদ্‌বৃত্ত বণ্টন করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। তাঁর মতে, ইক্তা-প্রথার প্রচলনের ফলে এই নতুন অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইক্তার প্রধান কেন্দ্র বা সদর দপ্তর শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং তার অধীনস্থ গ্রামগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। মুসলমানদের আগমনের আগে যে শহরগুলি ছিল, তাদের জীবনের উৎস ছিল বাণিজ্য। এখন ইকতা-প্রথা প্রচলনের ফলে এই শহরগুলি বড়ো হতে থাকে। শহর-সভ্যতার এই নবজন্মের অন্যতম কারণ হল শহরগুলির কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য ও বিলাস দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা। বড়ো বড়ো শহরগুলির মধ্যে কিছু ছোটো ছোটো শহরেরও পত্তন ঘটে। গুজরাট, রাজস্থান প্রভৃতি অঞ্চলে বাণিজ্য চলাচলকারী পথের ওপর এই ধরনের শহরগুলি গড়ে ওঠে। ইরফান হাবিব তাঁর 'ইকনমিক হিস্ট্রি অফ মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া' গ্রন্থে (২০০১) স্বীকার করেছেন যে, সুলতানি আমলে নগর-অর্থনীতির বিকাশ প্রধানত তিনটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অগ্রগতির মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। এগুলি হল—

  1. শহরের সংখ্যা ও আয়তনে বৃদ্ধি, 
  2. হস্তশিল্প উৎপাদনে লক্ষণীয় অগ্রগতি এবং 
  3. বাণিজ্যের যথেষ্ট বিস্তার।

প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে ভারতে ঘনবসতিপূর্ণ বহু শহরের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। বিশেষত দিল্লিকে কেন্দ্র করে কুতুব-দিল্লি, কিলখোরী, সিরি, তুঘলকাবাদ, ফিরোজাবাদ ইত্যাদি শহর সুলতানি যুগে যথেষ্ট জনবহুল সমৃদ্ধ ও ব্যস্ত শহর হিসেবে খ্যাত ছিল। দিল্লি নামের উৎপত্তি ‘ধিল্লি” বা “ধিল্লিকা' নাম থেকে।' প্রত্নতত্ত্ববিদ কানিংহাম ও পারসিক ঐতিহাসিক ফেরিস্তার মতে, রাজা ধিলু বা দিলু'র নাম থেকে ‘দিল্লি' নামের উৎপত্তি। কিংবদন্তী অনুসারে রাজপুত তোমর-বংশীয় কোনো রাজা ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে ‘দিল্লি' শহরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে ইতিহাসগতভাবে এই ধারণা সমর্থিত হয়নি। কুতুবমিনারের পাশে অবস্থিত লৌহস্তম্ভের (চন্দ্র রাজার স্তম্ভ নামে পরিচিত) ওপর রাজা অনঙ্গপালের একটি লেখতে বলা হয়েছে যে, ১১০৯ সম্বৎ বর্ষে রাজা অঙ্গ দিল্লিতে লোকবসতি করেন।' অর্থাৎ ১০৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দে শহর হিসেবে দিল্লির আবির্ভাব ঘটে। পুরাণ, মহাভারতে দিল্লির নামের বিক্ষিপ্ত উল্লেখের ভিত্তিতে কেউ কেউ মনে করেন যে, দিল্লির অধিষ্ঠান কয়েক শত বছর আগেই ঘটেছিল। কিন্তু ড. অনিরুদ্ধ রায় দেখিয়েছেন যে, আলোকজান্ডারের সাথে আগত গ্রিক ঐতিহাসিক কিংবা হিউয়েন সাঙ -এর ভারত ভ্রমণ পর্যন্ত সময়ে আগত চিনা পর্যটকদের রচনাতেও দিল্লি নামের উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি গজনির সুলতান মামুদ মথুরা ও কনৌজ লুঠ করলেও, দিল্লির কোনো প্রসঙ্গ তখনও পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক রায়ের মতে, প্রাচীনকালে দিল্লির অস্তিত্ব থাকলেও, তা পরে পরিত্যক্ত হয়েছিল। ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অনঙ্গপাল নতুন করে দিল্লির পত্তন করেন।

ত্রয়োদশ শতকে দিল্লিতে জলের সমস্যা ছিল প্রকট। পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় কূপ খনন করাও সহজ ছিল না। ইলতুৎমিস ‘হাউজ-ই-সামশি' নামে একটি জলাশয় খনন করে জলসমস্যার সাময়িক সমাধান করেন। এই সময় মানুষ ক্রমশ যমুনা নদীর দিকে সরে গিয়ে বসবাস করার চেষ্টা করে। একই সময় বলবনের নাতি (বুগরা খাঁ'র পুত্র) কাইকোবাদ দিল্লি প্রাসাদের কঠোর নিয়মকানুন থেকে মুক্ত হয়ে আমোদপ্রমোদ করার জন্য যমুনার তীরে কিলখোরী প্রাসাদ তৈরি করেন। বারাণী লিখেছেন যে, বহু আমির, মালিক ও সাধারণ মানুষ কিলখোরী প্রাসাদের সন্নিকটে এসে বসবাস করতে থাকেন। এইভাবে এখানে নতুন শহর গড়ে ওঠে। এটি ‘শহর-ই-নৌ' নামে পরিচিত ছিল। জালালউদ্দিন খলজির আমলে এই শহরের আরও প্রসার হয় এবং নতুন নতুন বাজারের পত্তন হয়। আলাউদ্দিন খলজি অস্থায়ীভাবে কিলখোরীতে থাকার পর মহাসমারোহে দিল্লির ‘কওশকে লাল' শহরে রাজধানী স্থানান্তর করেন। তবে মোঙ্গল আক্রমণের প্রেক্ষিতে দিল্লি ও কিলখোরীর মধ্যবর্তী স্থানে সিরি দুর্গ ও প্রাসাদ প্রতিষ্ঠা করেন। জনবসতির ক্রমবৃদ্ধির ফলে এই তিনটি শহরের মধ্যে প্রভেদ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক সিংহাসনে বসার (১৩২০ খ্রিঃ) পর কুতুবমিনারের প্রায় ৫ মাইল দূরে একটি দুর্গ নির্মাণ করে মালিক, আমির ও নিজ পরিবার-পরিজনসহ বসবাস শুরু করেন। অনেকে মনে করেন, এখানেই তুঘলকাবাদ শহরের উৎপত্তি ঘটে। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতে, তুঘলকাবাদ শহরটি পরিকল্পিত ভাবেই নির্মিত ছিল। অধ্যাপক আতহার আলির মতে, এই শহরে প্রধানত সুলতান ও তাঁর সেনানায়করা বসবাস করতেন। দিল্লির পরিবর্ত শহর হিসেবে এটির পরিকল্পনা করা হয়নি। মহম্মদ-বিন-তুঘলক এক দীর্ঘ পাঁচিল দিয়ে দিল্লি, সিরি ও তুঘলকাবাদকে ঘিরে দেন। ফলে তিনটি শহর মিলিত হয়ে একটি বৃহত্তর শহরের পত্তন ঘটে। এর নতুন নামকরণ করা ‘জাহানপনা'। মহম্মদ তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তরের সূত্রে দেবগিরি শহরে চরিত্র পরিগ্রহ করে। এর নতুন নাম হয় ‘দৌলতাবাদ'। ইবন বতুতা বলেছেন যে, দৌলতাবাদ তার বিশালতা ও বৈভবের বিচারে দিল্লি থেকে খুব পিছিয়ে ছিল না। অবশ্য তিনি এও বলেছেন যে, দৌলতাবাদে নতুন রাজধানী স্থানান্তরিত হলেও, ব্যস্ত শহর হিসেবে দিল্লির রমরমা অক্ষুণ্ণ ছিল। জিয়াউদ্দিন বারাণীর রচনা থেকে জানা যায় যে, ফিরোজ শাহ তুঘলক যমুনার নিকটে একটি বৃহৎ দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। পরে এখানেই রাজধানী সরিয়ে আনেন। এটির নাম হল 'ফিরোজাবাদ'। এই শহর তুঘলকাবাদের চেয়ে বড়ো ছিল। দেড়শো বছর পরে এটি পরিত্যক্ত হয়। বর্তমানে এর ধ্বংসস্তূপটুকুই দেখা যায়। সুলতান মুইজউদ্দিন মুবারক শাহ পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে ‘মুবারকাবাদ' শহরের পত্তন করেন। এর প্রায় এক শতক পরে হুমায়ুন নির্মাণ করেন ‘দিনপনাহ’শহর। তীব্র জলাভাব, তৈমুর লঙ-এর আক্রমণ (১৩৯৯ খ্রিঃ) ও ধ্বংসকার্যের ফলে দিল্লির জৌলুষ স্নান হয়ে যায়। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকেই দিল্লির পরিবর্তে আগ্রা রাজধানী শহর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

দিল্লির সাথে দূরের শহরগুলির পথ যোগাযোগ ছিল। বদায়ুন, কনৌজ, অযোধ্যা, কারা, আজমির, মুলতান, দৌলতাবাদ প্রভৃতি শহরের সাথে স্থলপথে যোগাযোগ ছিল। মহম্মদ তুঘলক রাজধানী স্থানান্তরের সময় দিল্লি ও দৌলতাবাদের মধ্যে পথ সংযোগ তৈরি করেন। মুলতান ও কান্দাহারের রাস্তা ধরে মধ্য-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে যাওয়া যেত। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী রাজধানী শহরগুলি সদাব্যস্ত থাকত। তাই দিল্লির শহরগুলিতে দেশি ও বিদেশি বণিকদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যেত। দেশি বণিকদের মধ্যে হিন্দু মুলতানি বণিকদের দেখা যায়। অবশ্য মুলতানি মুসলমান বণিকরাও ছিল। বিদেশিদের মধ্যে প্রধান ছিল আরব, তুর্কি, খোরাসানি, চিন ও মধ্য-এশিয়ার বণিকেরা। বণিকদের জন্য গোয়া শহর জুড়ে সরাইখানা নির্মিত ছিল। ফিরোজ তুঘলক প্রায় ১২০ টি সরাইখানা নির্মাণ করেছিলেন। সাধারণত সরাইখানায় থাকা-খাওয়ার জন্য ভ্রমণকারীদের কোনো খরচ করতে হত না। ধনী ও সাধারণ পর্যটকদের সরাইখানা ঘরগুলি পৃথক পৃথক মানের তৈরি করা হত।

তিনটি কেন্দ্রীয় বাজারে খাদ্যশস্য, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যেত। খাদ্যশস্যের বাজারকে বলা হত ‘মাওভি'। এখান থেকে শহরের ছোটো ছোটো বাজারে শস্য জোগান দেওয়া হত। কাপড়ের বাজারকে বলা হত 'বাজাজতীত'। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের শাখা ছিল। পশুপাখি ও দাসদের জন্য পৃথক বাজার ছিল। এই বাজারের নাম ছিল 'নাখখাস'। চতুর্দশ শতকে দিল্লিতে দুটি 'নাখখাস' ছিল। তবে সুলতানি আমলে দাসদের কোনোরকম হীন চোখে দেখা হত না। দাসব্যবস্থাও বৈধ ছিল। দাসত্বমুক্ত হয়ে সাধারণ মানুষের মতো জীবনধারণ করা যেত। ১২০৬ থেকে ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে দিল্লির ইলবেরি তুর্কি সুলতানরা সবাই ছিলেন প্রাক্তন দাস।

দিল্লির শহরের কাঠামোর মধ্যে ধর্মীয় বা জাতিগত বিভেদ দেখা যায় না। অনিরুদ্ধ রায় লিখেছেন যে, পরিকল্পনাহীনভাবে শহর গড়ে ওঠায় ঘন ঘন শহর কেন্দ্রের পরিবর্তন হবার ফলে বিশ্বাস বা জাতের ভিত্তিতে শহর গড়ে ওঠেনি।

রাজস্থানের শহরগুলি প্রধানত দুর্গকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। আদি-মধ্যযুগে এখানকার শহরগুলির মধ্যে আবদ্ধ বাণিজ্যসম্পর্ক ছিল। কালক্রমে শহরগুলিকে পাঁচিল দ্বারা বেষ্টনী করে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। অবশ্য দুর্গগুলিও পৃথক পাঁচিল দ্বারা সুরক্ষিত ও স্বতন্ত্র ছিল। তুর্কি-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সময় (১৩ ১৪ শতক) রাজস্থানের শহরগুলির বিকাশ কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাজপুতদের উপজাতীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও এজন্য কিছুটা দায়ী ছিল। চতুর্দশ শতকে দিল্লি-সুলতানির অবক্ষয়ের কালে আঞ্চলিক শক্তির বিকাশ শুরু হলে পুরোনো শহরগুলির পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং নতুন শহরের পত্তন শুরু হয়। প্রশাসনিক কেন্দ্রে হিসেবে গড়ে ওঠা কয়েকটি শহর হল যোধপুর, নাগোর, জারে, পোখরান ইত্যাদি। বাণিজ্যিক কারণেও কয়েকটি ছোটো ছোটো শহরের আবির্ভাব ঘটে। উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারত বা পশ্চিম ভারতে যাতায়াতের বড়ো বড়ো পথগুলি রাজস্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই পথ ধরে বাণিজ্য কারাভান যাতায়াত করত। এই বাণিজ্য সুত্রে হনুমানগড়, বারমের, মেরতা প্রভৃতি ছোটো ছোটো শহরগুলির উৎপত্তি হয়েছে। রাজস্থানের শহরগুলির গঠন-কাঠামো প্রায় একই রকম। প্রতিটি শহর পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের বাইরে জল ভর্তি পরিখা। পাঁচিলের ভেতরে জলহীন টানা কৃত্রিম খাদ কাটা। নিরাপত্তার কারণে এই ব্যবস্থা। রাস্তাগুলি অপরিকল্পিত। শহর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলোমেলোভাবে রাস্তাগুলি গজিয়ে উঠেছে। উচ্চশ্রেণি ও নিম্নশ্রেণির লোকেরা সাধারণত শহরের ভিন্ন প্রান্তে বসবাস করত।

আল-মাসুদির রচনা থেকে গুজরাটে ক্যাম্বে উপসাগরের দু-পারে বহু গ্রাম ও শহরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। মাহী নদীর উত্তরে ছিল কাম্বে বা বর্তমানে খাম্বাজ বন্দর। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এই বন্দরের পত্তন হয়। দশম শতকের শেষদিকে মূলরাজ শোলাঙ্কি গুজরাট জয় করে নতুন খাম্বাজ শহরের পত্তন করেন। মার্কোপোলো তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে 'খাম্বাজ'কে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্র বলে বর্ণনা করেছেন। পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় প্রথম আহমদ শাহ দধিমতি নদীর তীরে দোহাদ শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। দোহাদে প্রাপ্ত একটি শিলালেখ থেকে চম্পানীর, আহমদাবাদ, বাগলানা ইত্যাদি শহরের অস্তিত্ব জানা যায়। মহম্মদ বেগস্হা পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চম্পানীর শহরকে নতুনভাবে সজ্জিত করেন। তিনি আহমদাবাদের পাঁচিশ মাইল দূরে মহম্মদাবাদ নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন।

আহমদ শাহ গুজরাট দখল করে অসওয়াল গ্রামে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন (১৪১১ খ্রিঃ)। ১৪২৮ খ্রিস্টাব্দে রাজপুতদের হাত থেকে ইদর দখল করে আহমদ শাহ সেখানে রাজধানী সরিয়ে আনেন। এর নাম দেন আহমদাবাদ। পরবর্তীকালে এটি হিম্মতনগর নামে পরিচিত হয়েছিল। পর্যটক বারথোমা, উইলিয়াম ফিঞ্চ প্রমুখ আহমদাবাদ শহরের ব্যস্ততা ও গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন।



চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময় দিল্লি-সুলতানদের ক্ষমতা হ্রাস পেলে দক্ষিণ ভারতে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের উত্থান ঘটে। পূর্ব ভারতে স্থাপিত হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি। এই সকল আঞ্চলিক রাজ্যের নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন নতুন শহরের পত্তন ঘটে। ড. অনিরুদ্ধ রায়ের মতে, বাংলা, বিজয়নগর ও বাহমনী-তিনটি রাজ্যের ক্ষেত্রেই স্থানীয় শক্তির স্বাধীনতা প্রকাশের মধ্যে নগরায়ণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে।` দাক্ষিণাত্যের সদাহ আমিরদের বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে আলাউদ্দিন হাসান বাহমান শাহ্ স্বাধীন বাহমনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন (১৩৪৭ খ্রিঃ)। নতুন রাজ্যের রাজধানী হিসেবে গুলবর্গা শহর জনবহুল ও সম্পদশালী হয়ে ওঠে। কালক্রমে গুলবর্গায় জনসংখ্যার চাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে সুলতান ফিরোজ শাহ ভীমা ও বহরা নদীর সঙ্গমস্থলে ‘ফিরোজাবাদ' শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। এখানকার স্থাপত্যশিল্প বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তুঘলক স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব মুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র আঞ্চলিক শিল্পশৈলীর প্রথম প্রকাশ ঘটে ফিরোজাবাদের মসজিদ ও প্রাসাদগুলিতে। সুলতান আহমদ শাহ ১৪২৪ খ্রিস্টাব্দে বিদরে রাজধানী স্থানান্তর করেন। সম্ভবত, রাজধানী শহর হিসেবে ফিরোজাবাদের আয়তন যথেষ্ট ছিল না। তা ছাড়া এই শহরটি বাহমনী সাম্রাজ্যের ঠিক কেন্দ্রস্থলে ছিল না। তুলনামূলকভাবে দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ের কোল ঘেঁষা বিদরের অবস্থান অধিক নিরাপদ ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সুবিধাজনক ছিল। নিকিতনের বিবরণ অনুযায়ী বিদরে লোকসংখ্যার চাপ ছিল প্রচুর। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য ছিল দৃষ্টিকটু রূপে প্রকট। তবে রাজনৈতিক প্রয়োজনে গড়ে তোলা বহু শহরের মতো বিদর পরিতক্ত হয়নি। রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব চলে যাওয়ার পরেও সাধারণ শহর হিসেবে বিদর আকর্ষণীয় ছিল।

তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে স্বাধীন বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন (১৩৩৬ খ্রিঃ) হরিহর ও বুক্ক নামক দুই ভাই। তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণ তীরে গড়ে ওঠে বিজয়নগর শহর। অসংখ্য সুদৃশ্য প্রাসাদ ও মন্দিরে সুসজ্জিত বিজয়নগর ছিল সম্ভবত ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো মধ্যযুগীয় শহর। অনেকগুলি পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে থাকা বিজয়নগর ছিল অনেকটা রোম শহরের মতো। পর্যটক পায়েজ বিজয়নগর শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিকল্পনা, বৈচিত্র্য, জনসংখ্যা ও সচ্ছলতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অসংখ্য হ্রদ, ফল ও ফুলের বাগিচা, পাহাড়ী ঝরনা, প্রশস্ত পথঘাট সুদৃশ্য প্রাসাদ ও মন্দিরে সুসজ্জিত বিজয়নগর শহরটি ছিল যে-কোনো পর্যটকের কাছেই আকর্ষণের বস্তু। ষোড়শ শতকের শেষদিকে (১৫৫৬ খ্রিঃ) মুসলমান যোদ্ধাদের অবাধ ধ্বংসকার্য এবং কিছু স্থানীয় অভিজাত ও গ্রামীণ উপজাতীয় মানুষের বিদ্রোহের ফলে এই সুন্দর শহরটি ধ্বংস হয়। রাজা কৃষ্ণদেব রায় নাগলপুরে (বর্তমান হসপেট) একটি শহর নির্মাণ করেছিলেন বলে পোর্তুগিজ পর্যটক নুনিজ উল্লেখ করেছেন।
মধ্যযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল গোয়া। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে কাদম্ব বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ত্রিলোচন কাদম্ব গোয়া শহরের পত্তন করেছিলেন। পরে একে একে বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্য এবং পোর্তুগিজ বণিকরা গোয়া শহর দখল করে। পোর্তুগিজ ঐতিহাসিকদের মতে, পোর্তুগিজরা ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে গোয়াকে বিজয়নগর থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। আলবুকার্ক এর আমলে গোয়া শহরের পৌর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির নানা কর্মসূচি রূপায়িত হয়। মিশনারি সেন্ট জেভিয়ার ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে গোয়া শহর পরিদর্শন করে এই শহরের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
দ্বাদশ শতকের শেষদিকে বারেন্দ্র ও রাঢ় এলাকায় ভাগীরথীর তীরে কয়েকটি নগরের উদ্ভব বা বিকাশ ঘটেছিল বলে ড. অনিরুদ্ধ রায় উল্লেখ করেছেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর রচনা থেকে বারেন্দ্রভূমির ‘রামাবতী নগরের কথা জানা যায়। কবি ধোয়ী সেন রাজাদের রাজধানী হিসেবে ‘বিজয়পুরা' শহরের কথা উল্লেখ করেছেন। মিনহাজউদ্দিন বাংলা দখল করেছিলেন। নদীয়া যে একটি বড়ো শহর ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তবে নদীয়ার অবস্থান বিতর্কিত। অনেকের মতে, উক্ত নদীয়া এবং রাজশাহি জেলার ‘নৌদিয়া' অভিন্ন। এ ছাড়া পাণ্ডুয়া, লক্ষণাবতী, গৌড় ইত্যাদি মধ্যযুগে বাংলার প্রখ্যাত শহর হিসেবে ব্যস্ত ও জনবহুল ছিল।

আশা করি আমার ভাই বোনের এই পোস্টটি অনেক ভালো লেগেছে। এর সাথে সুলতানি আমলে নগরের বিকাশ ,মধ্যযুগের ভারতে নগরের বিকাশ বিষয়টিও তোমরা বুঝতে পেরেছ। যদি এই পোস্টটি থেকে কিছু উপকার পাও, তাহলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে কখনো ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন