রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা

আজকে আমরা দেখবো কিছুৃ বিশেষ কিছু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে “গুরুদেব”, “কবিগুরু” ও “বিশ্বকবি” অভিধায় ভূষিত করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা  সবাই পছন্দ করে। তাই সেইসব পাঠকের জন্য আমরা নিয়ে আসলাম কিছু বিশেষ কবিতা। আপনারা এখানে সবরকমের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা পাবেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র 

এখান থেকে সব কবিতা পেয়ে যাবেন:


১৪০০ সাল 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে--
আজি হতে শতবর্ষ পরে।
আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ--
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব কি পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ পরে?।


তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
ভেবে দেখো মনে--
একদিন শতবর্ষ আগে
চঞ্চল পুলকরাশি কোন্‌ স্বর্গ হতে ভাসি
নিখিলের মর্মে আসি লাগে--
নবীন ফাল্গুনদিন সকল বন্ধনহীন
উন্মত্ত অধীর--
উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
দক্ষিণসমীর--
সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দিয়েছে ধরা
যৌবনের রাগে
তোমাদের শতবর্ষ আগে।
সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে,
কবি এক জাগে--
কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়
কত অনুরাগে
একদিন শতবর্ষ আগে।
আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন করিছে গান সে কোন্‌ নূতন কবি
তোমাদের ঘরে?
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব
পল্লবমর্মরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।



২ ফাল্গুন, ১৩০২






 #2

অকর্মার বিভ্রাট 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা,
তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা?
যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি
সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি।
ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খ'সে,
দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব'সে।
ফলাখানা টুটে গেল, হল্‌খানা তাই
খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই।
চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা,
এরে আজ চালা করে ধরাইব আখা।
হল্‌ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে--
খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।






 #3

অক্ষমতা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা —
সলিল রয়েছে প'ড়ে, শুধু দেহ নাই।
এ কেবল হৃদয়ের দুর্বল দুরাশা
সাধের বস্তুর মাঝে করে চাই - চাই।
দুটি চরণেতে বেঁধে ফুলের শৃঙ্খল
কেবল পথের পানে চেয়ে বসে থাকা!
মানবজীবন যেন সকলি নিষ্ফল —
বিশ্ব যেন চিত্রপট, আমি যেন আঁকা!
চিরদিন বুভুক্ষিত প্রাণহুতাশন
আমারে করিছে ছাই প্রতি পলে পলে,
মহত্ত্বের আশা শুধু ভারের মতন
আমারে ডুবায়ে দেয় জড়ত্বের তলে।
কোথা সংসারের কাজে জাগ্রত হৃদয়!
কোথা রে সাহস মোর অস্থিমজ্জাময়!






 #4

অক্ষমা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


যেখানে এসেছি আমি, আমি সেথাকার,
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখদুঃখভার
বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির।
অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে,
হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী।
সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে,
পারিস নে কত বার — 'কই অন্ন কই '
কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ।
জানি মা গো , তোর হাতে অসম্পূর্ণ সুখ—
যা কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায় ,
সব-তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভুক ,
সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়—
তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক!






 #5

অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ
আকস্মিক চেতনার নিবিড়তায়
চঞ্চল হয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,
তখন কোন্‌ কথা জানাতে তার এত অধৈর্য।
--যে কথা দেহের অতীত।
খাঁচার পাখির কণ্ঠে যে বাণী
সে তো কেবল খাঁচারি নয়,
তার মধ্যে গোপনে আছে সুদূর অগোচরের অরণ্য-মর্মর,
আছে করুণ বিস্মৃতি।
সামনে তাকিয়ে চোখের দেখা দেখি--
এ তো কেবলি দেখার জাল-বোনা নয়।--
বসুন্ধরা তাকিয়ে থাকেন নির্নিমেষে
দেশ-পারানো কোন্‌ দেশের দিকে,
দিগ্বলয়ের ইঙ্গিতলীন
কোন্‌ কল্পলোকের অদৃশ্য সংকেতে।
দীর্ঘপথ ভালোমন্দয় বিকীর্ণ,
রাত্রিদিনের যাত্রা দুঃখসুখের বন্ধুর পথে।
শুধু কেবল পথ চলাতেই কি এ পথের লক্ষ্য?
ভিড়ের কলরব পেরিয়ে আসছে গানের আহ্বান,
তার সত্য মিলবে কোন্‌খানে?
মাটির তলায় সুপ্ত আছে বীজ।
তাকে স্পর্শ করে চৈত্রের তাপ,
মাঘের হিম, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা।
অন্ধকারে সে দেখছে অভাবিতের স্বপ্ন।
স্বপ্নেই কি তার শেষ?
উষার আলোয় তার ফুলের প্রকাশ;
আজ নেই, তাই বলে কি নেই কোনোদিনই?






 #6

অচল স্মৃতি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি ।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি ।

যেখানে চরণ রেখেছে সে মোর
মর্ম গভীরতম —
উন্নত শির রয়েছে তুলিয়া
সকল উচ্চে মম ।
মোর কল্পনা শত
রঙিন মেঘের মতো
তাহারে ঘেরিয়া হাসিছে কাঁদিছে ,
সোহাগে হতেছে নত ।

আমার শ্যামল তরুলতাগুলি
ফুলপল্লবভারে
সরস কোমল বাহুবেষ্টনে
বাঁধিতে চাহিছে তারে ।
শিখর গগনলীন
দুর্গম জনহীন ,
বাসনাবিহগ একেলা সেথায়
ধাইছে রাত্রিদিন ।

চারি দিকে তার কত আসা-যাওয়া ,
কত গীত , কত কথা —
মাঝখানে শুধু ধ্যানের মতন
নিশ্চল নীরবতা ।
দূরে গেলে তবু , একা
সে শিখর যায় দেখা —
চিত্তগগনে আঁকা থাকে তার
নিত্যনীহাররেখা ।






 #7

অচলা বুড়ি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অচলবুড়ি, মুখখানি তার হাসির রসে ভরা
স্নেহের রসে পরিপক্ক অতিমধুর জরা।
ফুলো ফুলো দুই চোখে তার, দুই গালে আর ঠোঁটে
উছলে-পড়া হৃদয় যেন ঢেউ খেলিয়ে ওঠে।
পরিপুষ্ট অঙ্গটি তার, হাতের গড়ন মোটা,
কপালে দুই ভুরুর মাঝে উল্‌কি-আঁকা ফোঁটা।
গাড়ি-চাপা কুকুর একটা মরতেছিল পথে,
সেবা ক'রে বাঁচিয়ে তারে তুলল কোনোমতে।
খোঁড়া কুকুর সেই ছিল তার নিত্যসহচর;
আধপাগলি ঝি ছিল এক, বাড়ি বালেশ্বর।
দাদাঠাকুর বলত, 'বুড়ি, জমল কত টাকা,
সঙ্গে ওটা যাবে না তো, বাক্সে রইল ঢাকা,
ব্রাহ্মণে দান করতে না চাও নাহয় দাও-না-ধার,
জানোই তো এই অসময়ে টাকার কী দরকার।'
বুড়ি হেসে বলে, 'ঠাকুর, দরকার তো আছেই,
সেইজন্যে ধার না দিয়ে রাখি টাকা কাছেই।'

সাঁৎরাপাড়ার কায়েতবাড়ির বিধবা এক মেয়ে,
এককালে সে সুখে ছিল বাপের আদর পেয়ে।
বাপ মরেছে, স্বামী গেছে, ভাইরা না দেয় ঠাঁই--
দিন চালাবে এমনতরো উপায় কিছু নাই।
শেষকালে সে ক্ষুধার দায়ে, দৈন্যদশার লাজে
চলে গেল হাঁসপাতালে রোগীসেবার কাজে।
এর পিছনে বুড়ি ছিল, আর ছিল লোক তার
কংসারি শীল বেনের ছেলে মুকুন্দ মোক্তার।
গ্রামের লোকে ছি-ছি করে, জাতে ঠেলল তাকে,
একলা কেবল অচল বুড়ি আদর করে ডাকে।
সে বলে, 'তুই বেশ করেছিস যা বলুক-না যেবা,
ভিক্ষা মাগার চেয়ে ভালো দুঃখী দেহের সেবা।'

জমিদারের মায়ের শ্রাদ্ধ, বেগার খাটার ডাক--
রাই ডোম্‌নির ছেলে বললে, কাজের যে নেই ফাঁক,
পারবে না আজ যেতে। শুনে কোতলপুরের রাজা
বললে, ওকে যে ক'রে হোক দিতেই হবে সাজা।
মিশনরির স্কুলে প'ড়ে, কম্পোজিটরের
কাজ শিখে সে শহরেতে আয় করেছে ঢের--
তাই হবে কি ছোটোলোকের ঘাড়-বাঁকানো চাল।
সাক্ষ্য দিল হরিশ মৈত্র, দিল মাখনলাল--
ডাকলুঠের এক মোকদ্দমায় মিথ্যে জড়িয়ে ফেলে
গোষ্ঠকে তো চালান দিল সাত বছরের জেলে।
ছেলের নামের অপমানে আপন পাড়া ছাড়ি
ডোম্‌নি গেল ভিন গাঁয়েতে পাততে নতুন বাড়ি।
প্রতি মাসে অচলবুড়ি দামোদরের পারে
মাসকাবারের জিনিস নিয়ে দেখে আসত তারে।
যখন তাকে খোঁটা দিল গ্রামের শম্ভু পিসে
'রাই ডোম্‌নির 'পরে তোমার এত দরদ কিসে'
বুড়ি বললে, 'যারা ওকে দিল দুঃখরাশি
তাদের পাপের বোঝা আমি হালকা করে আসি।'

পাতানো এক নাতনি বুড়ির একজ্বরি জ্বরে
ভুগতেছিল স্বরূপগঞ্জে আপন শ্বশুরঘরে।
মেয়েটাকে বাঁচিয়ে তুলল দিন রাত্রি জেগে,
ফিরে এসে আপনি পড়ল রোগের ধাক্কা লেগে।
দিন ফুরলো, দেব্‌তা শেষে ডেকে নিল তাকে,
এক আঘাতে মারল যেন সকল পল্লীটাকে।
অবাক হল দাদাঠাকুর, অবাক স্বরূপকাকা,
ডোম্‌নিকে সব দিয়ে গেছে বুড়ির জমা টাকা।
জিনিসপত্র আর যা ছিল দিল পাগল ঝিকে,
সঁপে দিল তারই হাতে খোঁড়া কুকুরটিকে।
ঠাকুর বললে মাথা নেড়ে, 'অপাত্রে এই দান।
পরলোকের হারালো পথ, ইহলোকের মান।'


শান্তিনিকেতন,
আষাঢ়, ১৩৪৪

 #8

অচেনা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তোমারে আমি কখনো চিনি নাকো,
লুকানো নহ, তবু লুকানো থাকো।
ছবির মতো ভাবনা পরশিয়া
একটু আছ মনেরে হরষিয়া।


অনেক দিন দিয়েছ তুমি দেখা,
বসেছ পাশে, তবুও আমি একা।
আমার কাছে রহিলে বিদেশিনী,
লইলে শধু নয়ন মম জিনি।


বেদনা কিছু আছে বা তব মনে,
সে ব্যথা ঢাকে তোমারে আবরণে।
শূন্য-পানে চাহিয়া থাকো তুমি,
নিশ্বসিয়া উঠে কাননভূমি।


মৌন তব কী কথা বলে বুঝি,
অর্থ তারি বেড়াই মনে খুঁজি।
চলিয়া যাও তখন মনে বাজে--
চিনি না আমি, তোমারে চিনি না যে।






 #9

অজয় নদী 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এককালে এই অজয়নদী ছিল যখন জেগে
স্রোতের প্রবল বেগে
পাহাড় থেকে আনত সদাই ঢালি
আপন জোরের গর্ব ক'রে চিকন-চিকন বালি।
অচল বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে যখন ক্রমে ক্রমে
জোর গেল তার কমে,
নদীর আপন আসন বালি নিল হরণ করে,
নদী গেল পিছনপানে সরে;
অনুচরের মতো
রইল তখন আপন বালির নিত্য-অনুগত।
কেবল যখন বর্ষা নামে ঘোলা জলের পাকে
বালির প্রতাপ ঢাকে।
পূর্বযুগের আক্ষেপে তার ক্ষোভের মাতন আসে,
বাঁধনহারা ঈর্ষা ছোটে সবার সর্বনাশে।
আকাশেতে গুরুগুরু মেঘের ওঠে ডাক,
বুকের মধ্যে ঘুরে ওঠে হাজার ঘূর্ণিপাক।
তারপরে আশ্বিনের দিনে শুভ্রতার উৎসবে
সুর আপনার পায় না খুঁজে শুভ্র আলোর স্তবে।
দূরের তীরে কাশের দোলা, শিউলি ফুটে দূরে,
শুষ্ক বুকে শরৎ নামে বালিতে রোদ্‌দুরে।
চাঁদের কিরণ পড়ে যেথায় একটু আছে জল
যেন বন্ধ্যা কোন্‌ বিধবার লুটানো অঞ্চল।
নিঃস্ব দিনের লজ্জা সদাই বহন করতে হয়,
আপনাকে হায় হারিয়ে-ফেলা অকীর্তি অজয়।






 #10

অধরা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অধরা মাধুরী ধরা পড়িয়াছে
এ মোর ছন্দবন্ধনে।
বলাকাপাঁতির পিছিয়ে-পড়া ও পাখি,
বাসা সুদূরের বনের প্রাঙ্গণে।
গত ফসলের পলাশের রাঙিমারে
ধরে রাখে ওর পাখা,
জরা শিরীষের পেলব আভাস
ওর কাকলিতে মাখা।
শুনে যাও বিদেশিনী,
তোমার ভাষায় ওরে
ডাকো দেখি নাম ধরে।

ও জানে তোমারি দেশের আকাশ
তোমারি রাতের তারা,
তব যৌবন-উৎসবে ও যে
গানে গানে দেয় সাড়া,
ওর দুটি পাখা চঞ্চলি উঠে তব হৃৎকম্পনে।
ওর বাসাখানি তব কুঞ্জের
নিভৃত প্রাঙ্গনে।






 #11

অনন্ত জীবন 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ,
জনমেছি দু দিনের তরে--
যাহা মনে আসে তাই আপনার মনে
গান গাই আনন্দের ভরে।
এ আমার গানগুলি দু দণ্ডের গান
রবে না রবে না চিরদিন--
পুরব-আকাশ হতে উঠিবে উচ্ছ্বাস,
পশ্চিমেতে হইবে বিলীন।

তোরা ফুল, তোরা পাখি, তোরা খোলা প্রাণ,
জগতের আনন্দ যে তোরা,
জগতের বিষাদ-পাসরা।
পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দলহরী
তোরা তার একেকটি ঢেউ,
কখন উঠিলি আর কখন মিলালি
জানিতেও পারিল না কেউ।

নাই তোর নাই রে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
নদীস্রোতে কোটি কোটি মৃত্তিকার কণা
ভেসে আসে, সাগরে মিশায়--
জান না কোথায় তারা যায়!
একেকটি কণা লয়ে গোপনে সাগর
রচিছে বিশাল মহাদেশ,
না জানি কবে তা হবে শেষ!
মুহূর্তেই ভেসে যায় আমাদের গান,
জান না তো কোথায় তা যায়!
আকাশের সাগরসীমায়!
আকাশ-সমুদ্র-তলে গোপনে গোপনে
গীতরাজ্য হতেছে সৃজন,
যত গান উঠিতেছে ধরার আকাশে
সেইখানে করিছে গমন।
আকাশ পুরিয়া যাবে শেষ,
উঠিবে গানের মহাদেশ।

নাই তোর নাই রে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
কাল দেখেছিনু পথে হরষে খেলিতেছিল
দুটি ভাই গলাগলি করি
দেখেছিনু জানালায় নীরবে দাঁড়ায়েছিল
দুটি সখা হাতে হাতে ধরি,
দেখেছিনু কচি মেয়ে মায়ের বাহুতে শুয়ে
ঘুমায়ে করিছে স্তনপান,
ঘুমন্ত মুখের ‘পরে বরষিছে স্নেহধারা
স্নেহমাখা নত দু’নয়ান,
দেখেছিনু রাজপথে চলেছে বালক এক
বৃদ্ধ জনকের হাত ধরি--
কত কী যে দেখেছিনু, হয়তো সে-সব ছবি
আজ আমি গিয়েছি পাসরি।
তা বলে নাহি কি তাহা মনে?
ছবিগুলি মেশেনি জীবনে?
স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি
রচিতেছে জীবন আমার--
কোথা যে কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে
চিনিতে পারি নে তাহা আর।
হয়তো অনেকদিন দেখেছিনু ছবি এক
দুটি প্রাণী বাহুর বাঁধনে--
তাই আজ ছুটাছুটি এসেছি প্রভাতে উঠি
সখারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে।
হয়তো অনেক দিন শুনেছিনু পাখি এক
আনন্দে গাহিছে প্রাণ খুলি,
সহসা রে তাই আজ প্রভাতের মুখ দেখি
প্রাণ মন উঠিছে উথুলি।
সকলি মিশেছে আসি হেথা,
জীবনে কিছু না যায় ফেলা--
এই-যে যা-কিছু চেয়ে দেখি
এ নহে কেবলি ছেলেখেলা।

এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে
নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি,
চারি দিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম
জীবনের স্রোত মিশে আসি।
সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা,
কোটি কোটি তারা হতে ঝরে,
জগতের যত হাসি যত গান যত প্রাণ
ভেসে আসে সেই স্রোতোভরে--
মেশে আসি সেই সিন্ধু-’পরে।
পৃথ্বী হতে মহাস্রোত ছুটিতেছে অবিরাম
সেই মহাসাগর-উদ্দেশে,
আমরা মাটির কণা জলস্রোত ঘোলা করি
অবিশ্রাম চলিয়াছি ভেসে--
সাগরে পড়িব অবশেষে।
জগতের মাঝখানে সেই সাগরের তলে
রচিত হতেছে পলে পলে
অনন্ত-জীবন মহাদেশ,
কে জানে হবে কি তাহা শেষ!

তাই বলি, প্রাণ ওরে, গান গা পাখির মতো,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি--
তুই যাবি, গান যাবে, একসাথে ভেসে যাবে
তুই আর তোর গানগুলি।
মিশিবি সে সিন্ধুজলে অনন্তসাগরতলে,
একসাথে শুয়ে রবি প্রাণ,
তুই আর তোর এই গান।






 #12
অনন্ত প্রেম 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।






 #13
অনন্ত মরণ 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কোটি কোট ছোটো ছোটো মরণেরে লয়ে
বসুন্ধরা ছুটিছে আকাশে,
হাসে খেলে মৃত্যু চারিপাশে।
এ ধরণী মরণের পথ,
এ জগৎ মৃত্যুর জগৎ।

যতটুকু বর্তমান, তারেই কি বল’ প্রাণ?
সে তো শুধু পলক, নিমেষ।
অতীতের মৃত ভার পৃষ্ঠেতে রয়েছে তার,
না জানি কোথায় তার শেষ।
যত বর্ষ বেঁচে আছি তত বর্ষ মরে গেছি,
মরিতেছি প্রতি পলে পলে,
জীবন্ত মরণ মোরা মরণের ঘরে থাকি
জানি নে মরণ কারে বলে।

একমুঠা মরণেরে জীবন বলে কি তবে,
মরণের সমষ্টি কেবল?
একটি নিমেষ তুচ্ছ শত মরণের গুচ্ছ,
নাম নিয়ে এত কোলাহল।
মরণ বাড়িবে যত জীবন বাড়িবে তত,
পলে পলে উঠিব আকাশে
নক্ষত্রের কিরণনিবাসে।

মরণ বাড়িবে যত কোথায় কোথায় যাব,
বাড়িবে প্রাণের অধিকার--
বিশাল প্রাণের মাঝে কত গ্রহ কত তারা
হেথা হোথা করিবে বিহার ।
উঠিবে জীবন মোর কত-না আকাশ ছেয়ে,
ঢাকিয়া ফেলিবে রবি শশী--
যুগ-যুগান্তর যাবে, নব নব রাজ্য পাবে
নব নব তারায় প্রবেশি।

কবে রে আসিবে সেই দিন
উঠিব সে আকাশের পথে,
আমার মরণ-ডোর দিয়ে
বেঁধে দেব জগতে জগতে।
আমাদের মরণের জালে
জগৎ ফেলিব আবরিয়া,
এ অনন্ত আকাশসাগরে
দশ দিক রহিব ঘেরিয়া।

জয় হোক জয় হোক মরণের জয় হোক--
আমাদের অনন্ত মরণ,
মরণের হবে না মরণ।
এ ধরায় মোরা সবে শতাব্দীর ক্ষুদ্র শিশু
লইলাম তোমার শরণ।
এসো তুমি এসো কাছে, স্নেহ-কোলে লও তুমি,
পিয়াও তোমার মাতৃস্তন,
আমাদের করো হে পালন।
আনন্দে পুরেছে প্রাণ, হেরিতেছি এ জগতে
মরণের অনন্ত উৎসব।
কার নিমন্ত্রণে মোরা মহাযজ্ঞে এসেছি রে,
উঠেছে বিপুল কলরব।

যে ডাকিছে ভালোবেসে, তারে চিনিস নে শিশু?
তার কাছে কেন তোর ডর?
জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম,
মরণ তো নহে তোর পর।
আয়, তারে অলিঙ্গন কর্-
আয়, তার হাতখানি ধর্।





 #14
অনাগতা 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এসেছিল বহু আগে যারা মোর দ্বারে,
যারা চলে গেছে একেবারে,
ফাগুন-মধ্যাহ্নবেলা শিরীষছায়ায় চুপে চুপে
তারা ছায়ারূপে
আসে যায় হিল্লোলিত শ্যাম দুর্বাদলে।
ঘন কালো দিঘিজলে
পিছনে-ফিরিয়া-চাওয়া আঁখি জ্বলো জ্বলো
করে ছলোছলো।
মরণের অমরতালোকে
ধূসর আঁচল মেলি ফিরে তারা গেরুয়া আলোকে।


যে এখনো আসে নাই মোর পথে,
কখনো যে আসিবে না আমার জগতে,
তার ছবি আঁকিয়াছি মনে--
একেলা সে বাতায়নে
বিদেশিনী জন্মকাল হতে।
সে যেন শেঁউলি ভাসে ক্ষীণ মৃদু স্রোতে,
কোথায় তাহার দেশ
নাই সে উদ্দেশ।


চেয়ে আছে দূর-পানে
কার লাগি আপনি সে নাহি জানে।
সেই দূরে ছায়ারূপে রয়েছে সে
বিশ্বের সকল-শেষে
যে আসিতে পারিত তবুও
এল না কভুও।
জীবনের মরীচিকাদেশে
মরুকন্যাটির আঁখি ফিরে ভেসে ভেসে।

#15

অনাবৃষ্টি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


প্রাণের সাধন কবে নিবেদন
করেছি চরণতলে,
অভিষেক তার হল না তোমার
করুণ নয়নজলে।
রসের বাদল নামিল না কেন
তাপের দিনে।
ঝরে গেল ফুল মালা পরাই নি
তোমার গলে।

মনে হয়েছিল, দেখেছি করুণা
আঁখির পাতে-
উড়ে গেল কোথা শুকনো যূথীর সাথে।
যদি এ মাটিতে চলিতে চলিতে
পড়িত তোমার দান
এ মাটি লভিত প্রাণ,
একদা গোপনে ফিরে পেতে তারে
অমৃত ফলে।






 #16

অনেক হাজার বছরের 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অনেক হাজার বছরের
মরু-যবনিকার আচ্ছাদন
যখন উৎক্ষিপ্ত হল,
দেখা দিল তারিখ-হারানো লোকালয়ের
বিরাট কঙ্কাল;--
ইতিহাসের অলক্ষ্য অন্তরালে
ছিল তার জীবনক্ষেত্র।
তার মুখরিত শতাব্দী
আপনার সমস্ত কবিগান
বাণীহীন অতলে দিয়েছে বিসর্জন।
আর, যে-সব গান তখনো ছিল অঙ্কুরে, ছিল মুকুলে,
যে বিপুল সম্ভাব্য
সেদিন অনালোকে ছিল প্রচ্ছন্ন
অপ্রকাশ থেকে অপ্রকাশেই গেল মগ্ন হয়ে--
যা ছিল অপ্রজ্বল ধোঁওয়ার গোপন আচ্ছাদনে
তাও নিবল।
যা বিকাল, আর যা বিকাল না,--
দুই-ই সংসারের হাট থেকে গেল চলে
একই মূল্যের ছাপ নিয়ে।
কোথাও রইল না তার ক্ষত,
কোথাও বাজল না তার ক্ষতি।
ঐ নির্মল নিঃশব্দ আকাশে
অসংখ্য কল্প-কল্পান্তরের
হয়েছে আবর্তন।
নূতন নূতন বিশ্ব
অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে
জন্ম নিয়েছে আলোকে,
ভেসে চলেছে আলোড়িত নক্ষত্রের ফেনপুঞ্জে;
অবশেষে যুগান্তে তারা তেমনি করেই গেছে
যেমন গেছে বর্ষণশান্ত মেঘ,
যেমন গেছে ক্ষণজীবী পতঙ্গ।
মহাকাল, সন্ন্যাসী তুমি।
তোমার অতলস্পর্শ ধ্যানের তরঙ্গ-শিখরে
উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে সৃষ্টি
আবার নেমে যাচ্ছে ধ্যানের তরঙ্গতলে।
প্রচণ্ড বেগে চলেছে ব্যক্ত অব্যক্তের চক্রনৃত্য,
তারি নিস্তব্ধ কেন্দ্রস্থলে
তুমি আছ অবিচলিত আনন্দে।
হে নির্মম, দাও আমাকে তোমার ঐ সন্ন্যাসের দীক্ষা।
জীবন আর মৃত্যু, পাওয়া আর হারানোর মাঝখানে
যেখানে আছে অক্ষুব্ধ শান্তি
সেই সৃষ্টি-হোমাগ্নিশিখার অন্তরতম
স্তিমিত নিভৃতে
দাও আমাকে আশ্রয়।






 #17

অনেককালের একটিমাত্র দিন 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অনেককালের একটিমাত্র দিন
কেমন করে বাঁধা পড়েছিল
একটা কোনো ছন্দে, কোনো গানে,
কোনো ছবিতে।
কালের দূত তাকে সরিয়ে রেখেছিল
চলাচলের পথের বাইরে।
যুগের ভাসান খেলায়
অনেক কিছু চলে গেল ঘাট পেরিয়ে,
সে কখন ঠেকে গিয়েছিল বাঁকের মুখে
কেউ জানতে পারে নি।
মাঘের বনে
আমের কত বোল ধরল,
কত পড়ল ঝরে;
ফাল্গুনে ফুটল পলাশ,
গাছতলার মাটি দিল ছেয়ে;
চৈত্রের রৌদ্রে আর সর্ষের খেতে
কবির লড়াই লাগল যেন
মাঠে আর আকাশে।
আমার সেই আটকে-পড়া দিনটির গায়ে
কোনো ঋতুর কোনো তুলির
চিহ্ন লাগেনি।
একদা ছিলেম ঐ দিনের মাঝখানেই।
দিনটা ছিল গা ছড়িয়ে
নানা কিছুর মধ্যে;
তারা সমস্তই ঘেঁষে ছিল আশেপাশে সামনে।
তাদের দেখে গেছি সবটাই
কিন্তু চোখে পড়েনি সমস্তটা।
ভালোবেসেছি,
ভালো করে জানিনি
কতখানি বেসেছি।
অনেক গেছে ফেলাছড়া;
আনমনার রসের পেয়ালায়
বাকি ছিল কত।
সেদিনের যে পরিচয় ছিল আমার মনে
আজ দেখি তার চেহারা অন্য ছাঁদের।
কত এলোমেলো, কত যেমন-তেমন
সব গেছে মিলিয়ে।
তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়েছে যে
তাকে আজ দূরের পটে দেখছি যেন
সেদিনকার সে নববধূ।
তনু তার দেহলতা,
ধূপছায়া রঙের আঁচলটি
মাথায় উঠেছে খোঁপাটুকু ছাড়িয়ে।
ঠিকমতো সময়টি পাই নি।
তাকে সব কথা বলবার,
অনেক কথা বলা হয়েছে যখন-তখন,
সে-সব বৃথা কথা।
হতে হতে বেলা গেছে চলে।
আজ দেখা দিয়েছে তার মূর্তি,--
স্তব্ধ সে দাঁড়িয়ে আছে
ছায়া-আলোর বেড়ার মধ্যে,
মনে হচ্ছে কী একটা কথা বলবে,
বলা হল না,--
ইচ্ছে করছে ফিরে যাই পাশে,
ফেরার পথ নেই।






 #18

অন্তর মম বিকশিত করো 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
সুন্দর কর হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো,
অন্তরতর হে।

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
নন্দিত করো, নন্দিত করো,
নন্দিত করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।



শিলাইদহ
২৭ অগ্রাহায়ণ ১৩১৪
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৫






 #19

অন্তর্যামী 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী,
আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে
বলিতে দিতেছ কই।
অন্তরমাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই,
কোথা ভেসে যাই দূরে।
বলিতেছিলাম বসি এক ধারে
আপনার কথা আপন জনারে,
শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে
ঘরের কাহিনী যত--
তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে
ডুবায়ে ভাসায়ে নয়নের জলে
নবীন প্রতিমা নব কৌশলে
গড়িলে মনের মতো।

সে মায়ামুরতি কী কহিছে বাণী,
কোথাকার ভাব কোথা নিলে টানি--
আমি চেয়ে আছি বিস্ময়ে মানি
রহস্যে নিমগন।
এ যে সংগীত কোথা হতে উঠে,
এ যে লাবণ্য কোথা হতে ফুটে,
এ যে ক্রন্দন কোথা হতে টুটে
অন্তরবিদারণ।
নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায়
ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায়,
নূতন বেদনা বেজে উঠে তায়
নূতন রাগিণীভরে।
যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা,
যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা,
জানি না এনেছি কাহার বারতা
কারে শুনাবার তরে।
কে কেমন বোঝে অর্থ তাহার,
কেহ এক বলে কেহ বলে আর,
আমারে শুধায় বৃথা বার বার
দেখে তুমি হাস বুঝি।
কে গো তুমি, কোথা রয়েছ গোপনে,
আমি মরিতেছি খুঁজি।

এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী।
যে দিকে পান্থ চাহে চলিবারে
চলিতে দিতেছ কই।
গ্রামের যে পথ ধায় গৃহপানে,
চাষিগণ ফিরে দিবা-অবসানে,
গোঠে ধায় গোরু, বধূ জল আনে
শত বার যাতায়াতে,
একদা প্রথম প্রভাতবেলায়
সে পথে বাহির হইনু হেলায়--
মনে ছিল, দিন কাজে ও খেলায়
কাটায়ে ফিরিব রাতে।
পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক,
কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক,
ক্লান্তহৃদয় ভ্রান্ত পথিক
এসেছি নূতন দেশে।
কখনো উদার গিরির শিখরে
কভু বেদনার তমোগহ্বরে
চিনি না যে পথ সে পথের 'পরে
চলেছি পাগল-বেশে।
কভু বা পন্থ গহন জটিল,
কভু পিচ্ছল ঘনপঙ্কিল,
কভু সংকটছায়াশঙ্কিল,
বঙ্কিম দুরগম--
খরকণ্টকে ছিন্ন চরণ,
ধুলায় রৌদ্রে মলিন বরন,
আশেপাশে হতে তাকায় মরণ
সহসা লাগায় ভ্রম।
তারি মাঝে বাঁশি বাজিছে কোথায়,
কাঁপিছে বক্ষ সুখে ব্যথায়,
তীব্র তপ্ত দীপ্ত নেশায়
চিত্ত মাতিয়া উঠে।
কোথা হতে আসে ঘন সুগন্ধ,
কোথা হতে বায়ু বহে আনন্দ,
চিন্তা ত্যজিয়া পরান অন্ধ
মৃত্যুর মুখে ছুটে।

খেপার মতন কেন এ জীবন,
অর্থ কী তার, কোথা এ ভ্রমণ,
চুপ করে থাকি শুধায় যখন--
দেখে তুমি হাস বুঝি।
কে তুমি গোপনে চালাইছ মোরে
আমি যে তোমারে খুঁজি।

রাখো কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী।
আমার অর্থ তোমার তত্ত্ব
বলে দাও মোরে অয়ি।
আমি কি গো বীণাযন্ত্র তোমার,
ব্যথায় পীড়িয়া হৃদয়ের তার
মূর্ছনাভরে গীতঝংকার
ধ্বনিছ মর্মমাঝে?
আমার মাঝারে করিছ রচনা
অসীম বিরহ, অপার বাসনা,
কিসের লাগিয়া বিশ্ববেদনা
মোর বেদনায় বাজে?
মোর প্রেমে দিয়ে তোমার রাগিণী
কহিতেছ কোন্‌ অনাদি কাহিনী,
কঠিন আঘাতে ওগো মায়াবিনী
জাগাও গভীর সুর।
হবে যবে তব লীলা-অবসান,
ছিঁড়ে যাবে তার, থেমে যাবে গান,
আমারে কি ফেলে করিবে প্রয়াণ
তব রহস্যপুর?
জ্বেলেছ কি মোরে প্রদীপ তোমার
করিবারে পূজা কোন্‌ দেবতার

রহস্য-ঘেরা অসীম আঁধার
মহামন্দিরতলে?
নাহি জানি তাই কার লাগি প্রাণ
মরিছে দহিয়া নিশিদিনমান,
যেন সচেতন বহ্নিসমান
নাড়ীতে নাড়ীতে জ্বলে।
অর্ধনিশীথে নিভৃতে নীরবে
এই দীপখানি নিবে যাবে যবে
বুঝিবে কি, কেন এসেছিনু ভবে,
কেন জ্বলিলাম প্রাণে?
কেন নিয়ে এলে তব মায়ারথে
তোমার বিজন নূতন এ পথে,
কেন রাখিলে না সবার জগতে
জনতার মাঝখানে?
জীবন-পোড়ানো এ হোম-অনল
সেদিন কি হবে সহসা সফল?
সেই শিখা হতে রূপ নির্মল
বাহিরি আসিবে বুঝি!
সব জটিলতা হইবে সরল
তোমারে পাইব খুঁজি।

ছাড়ি কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী,
জীবনের শেষে কী নূতন বেশে
দেখা দিবে মোরে অয়ি!
চিরদিবসের মর্মের ব্যথা,
শত জনমের চিরসফলতা,
আমার প্রেয়সী, আমার দেবতা,
আমার বিশ্বরূপী,

মরণনিশায় উষা বিকাশিয়া
শ্রান্তজনের শিয়রে আসিয়া
মধুর অধরে করুণ হাসিয়া
দাঁড়াবে কি চুপিচুপি?
ললাট আমার চুম্বন করি
নব চেতনায় দিবে প্রাণ ভরি,
নয়ন মেলিয়া উঠিব শিহরি,
জানি না চিনিব কি না--
শূন্য গগন নীলনির্মল,
নাহি রবিশশী গ্রহমণ্ডল,
না বহে পবন, নাই কোলাহল,
বাজিছে নীরব বীণা--
অচল আলোকে রয়েছ দাঁড়ায়ে,
কিরণবসন অঙ্গ জড়ায়ে
চরণের তলে পড়িছে গড়ায়ে
ছড়ায়ে বিবিধ ভঙ্গে।
গন্ধ তোমার ঘিরে চারি ধার,
উড়িছে আকুল কুন্তলভার,
নিখিল গগন কাঁপিছে তোমার
পরশরসতরঙ্গে।
হাসিমাখা তব আনত দৃষ্টি
আমারে করিছে নূতন সৃষ্টি
অঙ্গে অঙ্গে অমৃতবৃষ্টি
বরষি করুণাভরে।
নিবিড় গভীর প্রেম-আনন্দ
বাহুবন্ধনে করেছে বন্ধ,
মুগ্ধ নয়ন হয়েছে অন্ধ
অশ্রুবাষ্পথরে।
নাহিকো অর্থ, নাহিকো তত্ত্ব,
নাহিকো মিথ্যা, নাহিকো সত্য,

আপনার মাঝে আপনি মত্ত--
দেখিয়া হাসিবে বুঝি।
আমি হতে তুমি বাহিরে আসিবে,
ফিরিতে হবে না খুঁজি।

যদি কৌতুক রাখ চিরদিন
ওগো কৌতুকময়ী,
যদি অন্তরে লুকায়ে বসিয়া
হবে অন্তরজয়ী,
তবে তাই হোক। দেবী, অহরহ
জনমে জনমে রহো তবে রহো,
নিত্যমিলনে নিত্যবিরহ
জীবনে জাগাও প্রিয়ে।
নব নব রূপে-- ওগো রূপময়,
লুণ্ঠিয়া লহো আমার হৃদয়,
কাঁদাও আমারে, ওগো নির্দয়,
চঞ্চল প্রেম দিয়ে।
কখনো হৃদয়ে কখনো বাহিরে,
কখনো আলোকে কখনো তিমিরে,
কভু বা স্বপনে কভু সশরীরে
পরশ করিয়া যাবে--
বক্ষোবীণায় বেদনার তার
এইমতো পুন বাঁধিব আবার,
পরশমাত্রে গীতঝংকার
উঠিবে নূতন ভাবে।
এমনি টুটিয়া মর্মপাথর
ছুটিবে আবার অশ্রুনিঝর,
জানি না খুঁজিয়া কী মহাসাগর
বহিয়া চলিবে দূরে।

বরষ বরষ দিবসরজনী
অশ্রুনদীর আকুল সে ধ্বনি
রহিয়া রহিয়া মিশিবে এমনি
আমার গানের সুরে।
যত শত ভুল করেছি এবার
সেইমতো ভুল ঘটিবে আবার--
ওগো মায়াবিনী, কত ভুলাবার
মন্ত্র তোমার আছে!
আবার তোমারে ধরিবার তরে
ফিরিয়া মরিব বনে প্রান্তরে,
পথ হতে পথে, ঘর হতে ঘরে
দুরাশার পাছে পাছে।
এবারের মতো পুরিয়া পরান
তীব্র বেদনা করিয়াছি পান,
সে সুরা তরল অগ্নিসমান
তুমি ঢালিতেছ বুঝি!
আবার এমনি বেদনার মাঝে
তোমারে ফিরিব খুঁজি।


ভাদ্র, ১৩০১






 #20

অপমান-বর 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে।
কুটির তাহার ঘিরিয়া দাঁড়ালো লাখো নরনারী এসে।
কেহ কহে 'মোর রোগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহো',
সন্তান লাগি করে কাঁদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ।
কেহ বলে 'তব দৈব ক্ষমতা চক্ষে দেখাও মোরে',
কেহ কয় 'ভবে আছেন বিধাতা বুঝাও প্রমাণ করে'।

কাঁদিয়া ঠাকুরে কাতর কবীর কহে দুই জোড়করে,
'দয়া করে হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে--
ভেবেছিনু কেহ আসিবেনা কাছে অপার কৃপায় তব,
সবার চোখের আড়ালে কেবল তোমায় আমায় রব।
একি কৌশল খেলেছ মায়াবী, বুঝি দিলে মোরে ফাঁকি।
বিশ্বের লোক ঘরে ডেকে এনে তুমি পালাইবে নাকি!'

ব্রাহ্মণ যত নগরে আছিল উঠিল বিষম রাগি--
লোক নাহি ধরে যবন জোলার চরণধুলার লাগি!
চারি পোওয়া কলি পুরিয়া আসিল পাপের বোঝায় ভরা,
এর প্রতিকার না করিলে আর রক্ষা না পায় ধরা।
ব্রাহ্মণদল যুক্তি করিল নষ্ট নারীর সাথে--
গোপনে তাহারে মন্ত্রণা দিল, কাঞ্চন দিল হাতে।

বসন বেচিতে এসেছে কবীর একদা হাটের বারে,
সহসা কামিনী সবার সামনে কাঁদিয়া ধরিল তারে।
কহিল,'রে শঠ, নিঠুর কপট, কহি নে কাহারো কাছে--
এমনি করে কি সরলা নারীরে ছলনা করিতে আছে!
বিনা অপরাধে আমারে ত্যজিয়া সাধু সাজিয়াছ ভালো,
অন্নবসন বিহনে আমার বরন হয়েছে কালো!'

কাছে ছিল যত ব্রাহ্মণদল করিল কপট কোপ,
'ভণ্ডতাপস, ধর্মের নামে করিছ ধর্মলোপ!
তুমি সুখে ব'সে ধুলা ছড়াইছ সরল লোকের চোখে,
অবলা অখলা পথে পথে আহা ফিরিছে অন্নশোকে!'
কহিল কবীর, 'অপরাধী আমি, ঘরে এসো নারী তবে--
আমার অন্ন রহিতে কেন বা তুমি উপবাসী রবে?'

দুষ্টা নারীরে আনি গৃহমাঝে বিনয়ে আদর করি
কবীর কহিল, 'দীনের ভবনে তোমারে পাঠাল হরি।'
কাঁদিয়া তখন কহিল রমণী লাজে ভয়ে পরিতাপে,
'লোভে পড়ে আমি করিয়াছি পাপ, মরিব সাধুর শাপে।'
কহিল কবীর, 'ভয় নাই মাতঃ, লইব না অপরাধ--
এনেছ আমার মাথার ভূষণ অপমান অপবাদ।'

ঘুচাইল তার মনের বিকার, করিল চেতনা দান--
সঁপি দিল তার মধুর কণ্ঠে হরিনামগুণগান।
রটি গেল দেশে--কপট কবীর, সাধুতা তাহার মিছে।
শুনিয়া কবীর কহে নতশির, 'আমি সকলের নীচে।
যদি কূল পাই তরণী-গরব রাখিতে না চাহি কিছু--
তুমি যদি থাক আমার উপরে আমি রব সব-নিচু।'

রাজার চিত্তে কৌতুক হল শুনিতে সাধুর গাথা।
দূত আসি তারে ডাকিল যখন সাধু নাড়িলেন মাথা।
কহিলেন, 'থাকি সবা হতে দূরে আপন হীনতা-মাঝে;
আমার মতন অভাজন জন রাজার সভায় সাজে!'
দূত কহে, 'তুমি না গেলে ঘটিবে আমাদের পরমাদ,
যশ শুনে তব হয়েছে রাজার সাধু দেখিবার সাধ।'

রাজা বসে ছিল সভার মাঝারে, পারিষদ সারি সারি--
কবীর আসিয়া পশিল সেথায় পশ্চাতে লয়ে নারী।
কেহ হাসে কেহ করে ভুরুকুটি, কেহ রহে নতশিরে,
রাজা ভাবে--এটা কেমন নিলাজ রমণী লইয়া ফিরে!
ইঙ্গিতে তাঁর সাধুরে সভার বাহির করিল দ্বারী,
বিনয়ে কবীর চলিল কুটিরে সঙ্গ লইয়া নারী।

পথমাঝে ছিল ব্রাহ্মণদল, কৌতুকভরে হাসে--
শুনায়ে শুনায়ে বিদ্রূপবাণী কহিল কঠিন ভাষে।
তখন রমণী কাঁদিয়া পড়িল সাধুর চরণমূলে--
কহিল, 'পাপের পঙ্ক হইতে কেন নিলে মোরে তুলে!
কেন অধমেরে রাখিয়া দুয়ারে সহিতেছ অপমান!'
কহিল কবীর, 'জননী, তুমি যে আমার প্রভুর দান।'


২৮ আশ্বিন, ১৩০৬






 #21

অপরাহ্নে এসেছিল জন্মবাসরের আমন্ত্রণে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অপরাহ্নে এসেছিল জন্মবাসরের আমন্ত্রণে
পাহাড়িয়া যত।
একে একে দিল মোরে পুষ্পের মঞ্জরি
নমস্কারসহ।
ধরণী লভিয়াছিল কোন্‌ ক্ষণে
প্রস্তর আসনে বসি
বহু যুগ বহ্নিতপ্ত তপস্যার পরে এই বর,
এ পুষ্পের দান,
মানুষের জন্মদিনে উৎসর্গ করিবে আশা করি।
সেই বর, মানুষেরে সুন্দরের সেই নমস্কার
আজি এল মোর হাতে
আমার জন্মের এই সার্থক স্মরণ।
নক্ষত্রে-খচিত মহাকাশে
কোথাও কি জ্যোতিঃসম্পদের মাঝে
কখনো দিয়েছে দেখা এ দুর্লভ আশ্চর্য সম্মান।






 #22

অবর্জিত 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমি চলে গেলে ফেলে রেখে যাব পিছু
চিরকাল মনে রাখিবে, এমন কিছু,
মূঢ়তা করা তা নিয়ে মিথ্যে ভেবে।
ধুলোর খাজনা শোধ করে নেবে ধুলো,
চুকে গিয়ে তবু বাকি রবে যতগুলো
গরজ যাদের তারাই তা খুঁজে নেবে।
আমি শুধু ভাবি, নিজেরে কেমনে ক্ষমি--
পুঞ্জ পুঞ্জ বকুনি উঠেছে জমি,
কোন্‌ সৎকারে করি তার সদ্‌গতি।
কবির গর্ব নেই মোর হেন নয়--
কবির লজ্জা পাশাপাশি তারি রয়,
ভারতীর আছে এই দয়া মোর প্রতি।
লিখিতে লিখিতে কেবলি গিয়েছি ছেপে,
সময় রাখি নি ওজন দেখিতে মেপে,
কীর্তি এবং কুকীর্তি গেছে মিশে।
ছাপার কালিতে অস্থায়ী হয় স্থায়ী,
এ অপরাধের জন্যে যে-জন দায়ী
তার বোঝা আজ লঘু করা যায় কিসে।
বিপদ ঘটাতে শুধু নেই ছাপাখানা,
বিদ্যানুরাগী বন্ধু রয়েছে নানা--
আবর্জনারে বর্জন করি যদি
চারি দিক হতে গর্জন করি উঠে,
"ঐতিহাসিক সূত্র দিবে কি টুটে,
যা ঘটেছে তারে রাখা চাই নিরবধি।"
ইতিহাস বুড়ো, বেড়াজাল তার পাতা,
সঙ্গে রয়েছে হিসাবের মোটা খাতা--
ধরা যাহা পড়ে ফর্দে সকলি আছে।
হয় আর নয়, খোঁজ রাখে শুধু এই,
ভালোমন্দর দরদ কিছুই নেই,
মূল্যের ভেদ তুল্য তাহার কাছে।
বিধাতাপুরুষ ঐতিহাসিক হলে
চেহারা লইয়া ঋতুরা পড়িত গোলে,
অঘ্রাণ তবে ফাগুন রহিত ব্যেপে।
পুরানো পাতারা ঝরিতে যাইত ভুলে,
কচি পাতাদের আঁকড়ি রহিত ঝুলে,
পুরাণ ধরিত কাব্যের টুঁটি চেপে।
জোড়হাত করে আমি বলি, "শোনো কথা,
সৃষ্টির কাজে প্রকাশেরি ব্যগ্রতা,
ইতিহাসটারে গোপন করে সে রাখে।
জীবনলক্ষ্মী মেলিয়া রঙের রেখা
ধরার অঙ্গে আঁকিছে পত্রলেখা,
ভূতত্ত্ব তার কঙ্কালে ঢাকা থাকে।
বিশ্বকবির লেখা যত হয় ছাপা
প্রুফ্‌শিটে তার দশগুণ পড়ে চাপা,
নব এডিশনে নূতন করিয়া তুলে।
দাগি যাহা, যাহে বিকার, যাহাতে ক্ষতি,
মমতামাত্র নাহি তো তাহার প্রতি--
বাঁধা নাহি থাকে ভুলে আর নির্ভুলে।
সৃষ্টির কাজ লুপ্তির সাথে চলে,
ছাপাযন্ত্রের ষড়যন্ত্রের বলে
এ বিধান যদি পদে পদে পায় বাধা--
জীর্ণ ছিন্ন মলিনের সাথে গোঁজা
কৃপণপাড়ার রাশীকৃত নিয়ে বোঝা
সাহিত্য হবে শুধু কি ধোপার গাধা।
যাহা কিছু লেখে সেরা নাহি হয় সবি,
তা নিয়ে লজ্জা না করুক কোনো কবি--
প্রকৃতির কাজে কত হয় ভুলচুক;
কিন্তু, হেয় যা শ্রেয়ের কোঠায় ফেলে
তারেও রক্ষা করিবার ভূতে পেলে
কালের সভায় কেমনে দেখাবে মুখ।
ভাবী কালে মোর কী দান শ্রদ্ধা পাবে,
খ্যাতিধারা মোর কত দূর চলে যাবে,
সে লাগি চিন্তা করার অর্থ নাহি।
বর্তমানের ভরি অর্ঘ্যের ডালি
অদেয় যা দিনু মাখায়ে ছাপার কালি
তাহারি লাগিয়া মার্জনা আমি চাহি।



 #23

অবসান 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


জানি দিন অবসান হবে,
জানি তবু কিছু বাকি রবে।
রজনীতে ঘুমহারা পাখি
এক সুরে গাহিবে একাকী-
যে শুনিবে, সে রহিবে জাগি
সে জানিবে, তারি নীড়হারা
স্বপন খুঁজিছে সেই তারা
যেথা প্রাণ হয়েছে বিবাগী।
কিছু পরে করে যাবে চুপ
ছায়াঘন স্বপনের রূপ।
ঝরে যাবে আকাশকুসুম,
তখন কূজনহীন ঘুম
এক হবে রাত্রির সাথে।
যে-গান স্বপনে নিল বাসা
তার ক্ষীণ গুঞ্জন-ভাষা
শেষ হবে সব-শেষ রাতে।






 #24

অবিচার 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


নারীর দুখের দশা অপমানে জড়ানো
এই দেখি দিকে দিকে ঘরে ঘরে ছড়ানো।
জানো কি এ অন্যায় সমাজের হিসাবে
নিমেষে নিমেষে কত হলাহল মিশাবে?
পুরুষ জেনেছে এটা বিধিনির্দিষ্ট
তাদের জীবন-ভোজে নারী উচ্ছিষ্ট।
রোগ-তাপে সেবা পায়, লয় তাহা অলসে--
সুধা কেন ঢালে বিধি ছিদ্র এ কলসে!
সমসম্মান হেথা নাহি মানে পুরুষে,
নিজ প্রভুপদমদে তুলে রয় ভুরু সে।
অর্ধেক কাপুরুষ অর্ধেক রমণী
তাতেই তো নাড়ীছাড়া এ দেশের ধমণী।
বুঝিতে পারে না ওরা-- এ বিধানে ক্ষতি কার।
জানি না কী বিপ্লবে হবে এর প্রতিকার।
একদা পুরুষ যদি পাপের বিরুদ্ধে
দাঁড়ায়ে নারীর পাশে নাহি নামে যুদ্ধে
অর্ধেক-কালি-মাখা সমাজের বুকটা
খাবে তবে বারে বারে শনির চাবুকটা।
এত কথা বৃথা বলা--যে পেয়েছে ক্ষমতা
নিঃসহায়ের প্রতি নাই তার মমতা,
আপনার পৌরুষ করি দিয়া লাঞ্ছিত
অবিচার করাটাই হয় তার বাঞ্ছিত।





 #25

অভিমান 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কারে দিব দোষ বন্ধু, কারে দিব দোষ!
বৃথা কর আস্ফালন, বৃথা কর রোষ।
যারা শুধু মরে কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ,
কেহ কভু তাহাদের করে নি সম্মান।
যতই কাগজে কাঁদি, যত দিই গালি,
কালামুখে পড়ে তত কলঙ্কের কালি।
যে তোমারে অপমান করে অহর্নিশ
তারি কাছে তারি 'পরে তোমার নালিশ!
নিজের বিচার যদি নাই নিজহাতে,
পদাঘাত খেয়ে যদি না পার ফিরাতে--
তবে ঘরে নতশিরে চুপ করে থাক্‌,
সাপ্তাহিকে দিগ্‌বিদিকে বাজাস নে ঢাক।
একদিকে অসি আর অবজ্ঞা অটল,
অন্য দিকে মসী আর শুধু অশ্রুজল।


২৬ চৈত্র, ১৩০২






 #26

অভিলাষ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ!
তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার ।
অতিক্রম করা যায় যত পান্থশালা ,
তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয় ।

তোমার বাঁশরি স্বরে বিমোহিত মন —
মানবেরা , ওই স্বর লক্ষ্য করি হায় ,
যত অগ্রসর হয় ততই যেমন
কোথায় বাজিছে তাহা বুঝিতে না পারে ।

চলিল মানব দেখো বিমোহিত হয়ে ,
পর্বতের অত্যুন্নত শিখর লঙ্ঘিয়া ,
তুচ্ছ করি সাগরের তরঙ্গ ভীষণ ,
মরুর পথের ক্লেশ সহি অনায়াসে ।

হিমক্ষেত্র , জনশূন্য কানন , প্রান্তর ,
চলিল সকল বাধা করি অতিক্রম ।
কোথায় যে লক্ষ্যস্থান খুঁজিয়া না পায় ,
বুঝিতে না পারে কোথা বাজিছে বাঁশরি ।

ওই দেখো ছুটিয়াছে আর-এক দল ,
লোকারণ্য পথমাঝে সুখ্যাতি কিনিতে ;
রণক্ষেত্রে মৃত্যুর বিকট মূর্তি মাঝে ,
শমনের দ্বার সম কামানের মুখে ।

ওই দেখো পুস্তকের প্রাচীর মাঝারে
দিন রাত্রি আর স্বাস্থ্য করিতেছে ব্যয় ।
পহুঁছিতে তোমার ও দ্বারের সম্মুখে
লেখনীরে করিয়াছে সোপান সমান ।

কোথায় তোমার অন্ত রে দুরভিলাষ
‘ স্বর্ণঅট্টালিকা মাঝে ?' তা নয় তা নয় ।
‘ সুবর্ণখনির মাঝে অন্ত কি তোমার ?'
তা নয় , যমের দ্বারে অন্ত আছে তব ।

তোমার পথের মাঝে , দুষ্ট অভিলাষ ,
ছুটিয়াছে মানবেরা সন্তোষ লভিতে ।
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা ,
তোমার পথের মাঝে সন্তোষ থাকে না!

নাহি জানে তারা হায় নাহি জানে তারা
দরিদ্র কুটির মাঝে বিরাজে সন্তোষ ।
নিরজন তপোবনে বিরাজে সন্তোষ ।
পবিত্র ধর্মের দ্বারে সন্তোষ আসন ।

১০
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
তোমার কুটিল আর বন্ধুর পথেতে
সন্তোষ নাহিকো পারে পাতিতে আসন ।
নাহি পশে সূর্যকর আঁধার নরকে ।

১১
তোমার পথেতে ধায় সুখের আশয়ে
নির্বোধ মানবগণ সুখের আশয়ে ;
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
কটাক্ষও নাহি করে সুখ তোমা পানে ।

১২
সন্দেহ ভাবনা চিন্তা আশঙ্কা ও পাপ
এরাই তোমার পথে ছড়ানো কেবল
এরা কি হইতে পারে সুখের আসন
এ-সব জঞ্জালে সুখ তিষ্ঠিতে কি পারে ।

১৩
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
নির্বোধ মানবগন নাহি জানে ইহা
পবিত্র ধর্মের দ্বারে চিরস্থায়ী সুখ
পাতিয়াছে আপনার পবিত্র আসন ।

১৪
ওই দেখো ছুটিয়াছে মানবের দল
তোমার পথের মাঝে দুষ্ট অভিলাষ
হত্যা অনুতাপ শোক বহিয়া মাথায়
ছুটেছে তোমার পথে সন্দিগ্ধ হৃদয়ে ।

১৫
প্রতারণা প্রবঞ্চনা অত্যাচারচয়
পথের সম্বল করি চলে দ্রুতপদে
তোমার মোহন জালে পড়িবার তরে ।
ব্যাধের বাঁশিতে যথা মৃগ পড়ে ফাঁদে ।

১৬
দেখো দেখো বোধহীন মানবের দল
তোমার ও মোহময়ী বাঁশরির স্বরে
এবং তোমার সঙ্গী আশা উত্তেজনে
পাপের সাগরে ডুবে মুক্তার আশয়ে ।

১৭
রৌদ্রের প্রখর তাপে দরিদ্র কৃষক
ঘর্মসিক্ত কলেবরে করিছে কর্ষণ
দেখিতেছে চারি ধারে আনন্দিত মনে
সমস্ত বর্ষের তার শ্রমের যে ফল ।

১৮
দুরাকাঙ্ক্ষা হায় তব প্রলোভনে পড়ি
কর্ষিতে কর্ষিতে সেই দরিদ্র কৃষক
তোমার পথের শোভা মনোময় পটে
চিত্রিতে লাগিল হায় বিমুগ্ধ হৃদয়ে ।

১৯
ওই দেখো আঁকিয়াছে হৃদয়ে তাহার
শোভাময় মনোহর অট্টালিকারাজি
হীরক মাণিক্য পূর্ণ ধনের ভাণ্ডার
নানা শিল্পে পরিপূর্ণ শোভন আপণ ।

২০
মনোহর কুঞ্জবন সুখের আগার
শিল্প-পারিপাট্যযুক্ত প্রমোদভবন
গঙ্গা সমীরণ স্নিগ্ধ পল্লীর কানন
প্রজাপূর্ণ লোভনীয় বৃহৎ প্রদেশ ।

২১
ভাবিল মুহূর্ত-তরে ভাবিল কৃষক
সকলই এসেছে যেন তারি অধিকারে
তারি ওই বাড়ি ঘর তারি ও ভাণ্ডার
তারি অধিকারে ওই শোভন প্রদেশ ।

২২
মুহূর্তেক পরে তার মুহূর্তেক পরে
লীন হল চিত্রচয় চিত্তপট হতে
ভাবিল চমকি উঠি ভাবিল তখন
‘ আছে কি এমন সুখ আমার কপালে ?'

২৩
‘ আমাদের হায় যত দুরাকাঙ্ক্ষাচয়
মানসে উদয় হয় মুহূর্তের তরে
কার্যে তাহা পরিণত না হতে না হতে
হৃদয়ের ছবি হায় হৃদয়ে মিশায় । '

২৪
ওই দেখো ছুটিয়াছে তোমার ও পথে
রক্তমাখা হাতে এক মানবের দল
সিংহাসন রাজদণ্ড ঐশ্বর্য মুকুট
প্রভুত্ব রাজত্ব আর গৌরবের তরে ।

২৫
ওই দেখো গুপ্তহত্যা করিয়া বহন
চলিতেছে অঙ্গুলির ‘ পরে ভর দিয়া
চুপি চুপি ধীরে ধীরে অলক্ষিত ভাবে
তলবার হাতে করি চলিয়াছে দেখো ।

২৬
হত্যা করিতেছে দেখো নিদ্রিত মানবে
সুখের আশয়ে বৃথা সুখের আশয়ে
ওই দেখো ওই দেখো রক্তমাখা হাতে
ধরিয়াছে রাজদণ্ড সিংহাসনে বসি ।

২৭
কিন্তু হায় সুখলেশ পাবে কি কখন ?
সুখ কি তাহারে করিবেক আলিঙ্গন ?
সুখ কি তাহার হৃদে পাতিবে আসন ?
সুখ কভু তারে কিগো কটাক্ষ করিবে ?

২৮
নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে
যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে
বৃষ্টি বজ্র সহ্য করি যে সুখের তরে
ছুটিয়াছে আপনার অভীষ্ট সাধনে ?

২৯
কখনোই নয় তাহা কখনোই নয়
পাপের কী ফল কভু সুখ হতে পারে
পাপের কী শাস্তি হয় আনন্দ ও সুখ
কখনোই নয় তাহা কখনোই নয়

৩০
প্রজ্বলিত অনুতাপ হুতাশন কাছে
বিমল সুখের হায় স্নিগ্ধ সমীরণ
হুতাশনসম তপ্ত হয়ে উঠে যেন
তখন কি সুখ কভু ভালো লাগে আর ।

৩১
নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে
যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে
ছুটেছে না মানি বাধা অভীষ্ট সাধনে
মনস্তাপে পরিণত হয়ে উঠে শেষে ।

৩২
হৃদয়ের উচ্চাসনে বসি অভিলাষ
মানবদিগকে লয়ে ক্রীড়া কর তুমি
কাহারে বা তুলে দাও সিদ্ধির সোপানে
কারে ফেল নৈরাশ্যের নিষ্ঠুর কবলে ।

৩৩
কৈকেয়ী হৃদয়ে চাপে দুষ্ট অভিলাষ!
চতুর্দশ বর্ষ রামে দিলে বনবাস ,
কাড়িয়া লইলে দশরথের জীবন ,
কাঁদালে সীতায় হায় অশোক-কাননে ।

৩৪
রাবণের সুখময় সংসারের মাঝে
শান্তির কলস এক ছিল সুরক্ষিত
ভাঙিল হঠাৎ তাহা ভাঙিল হঠাৎ
তুমিই তাহার হও প্রধান কারণ ।

৩৫
দুর্যোধন-চিত্ত হায় অধিকার করি
অবশেষে তাহারেই করিলে বিনাশ
পাণ্ডুপুত্রগণে তুমি দিলে বনবাস
পাণ্ডবদিগের হৃদে ক্রোধ জ্বালি দিলে ।

৩৬
নিহত করিলে তুমি ভীষ্ম আদি বীরে
কুরুক্ষেত্র রক্তময় করে দিলে তুমি
কাঁপাইলে ভারতের সমস্ত প্রদেশ
পাণ্ডবে ফিরায়ে দিলে শূন্য সিংহাসন ।

৩৭
বলি না হে অভিলাষ তোমার ও পথ
পাপেতেই পরিপূর্ণ পাপেই নি র্মি ত
তোমার কতকগুলি আছয়ে সোপান
কেহ কেহ উপকারী কেহ অপকারী ।

৩৮
উচ্চ অভিলাষ! তুমি যদি নাহি কভু
বিস্তারিতে নিজ পথ পৃথিবীমণ্ডলে
তাহা হ ' লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি
বিস্তার করিত এই ধরাতল-মাঝে ?

৩৯
সকলেই যদি নিজ নিজ অবস্থায়
সন্তুষ্ট থাকিত নিজ বিদ্যা বুদ্ধিতেই
তাহা হ ' লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি
বিস্তার করিত এই ধরাতল-মাঝে ?






 #27

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
দেশ বিদেশে কতই ঘুরি -
এবার বলো আমার মনের কোণে
দেবে ধরা, ছলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয় -
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না।

না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।


বোলপুর, ১১ ভাদ্র ১৩১৬
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ২৩






 #28

অসময় 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


হয়েছে কি তবে সিংহদুয়ার বন্ধ রে?
এখনো সময় আছে কি, সময় আছে কি?
দূরে কলরব ধ্বনিছে মন্দ মন্দ রে---
ফুরালো কি পথ? এসেছি পুরীর কাছে কি?
মনে হয় সেই সুদূর মধুর গন্ধ রে
রহি রহি যেন ভাসিয়া আসিছে বাতাসে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।

ঐ কি প্রদীপ দেখা যায় পুরমন্দিরে?
ও যে দুটি তারা দূর পশ্চিমগগনে।
ও কি শিঞ্জিত ধ্বনিছে কনকমঞ্জীরে?
ঝিল্লির রব বাজে বনপথে সঘনে।
মরীচিকালেখা দিগন্তপথ রঞ্জি রে
সারাদিন আজি ছলনা করেছে হতাশে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।

এতদিনে সেথা বনবনান্ত নন্দিয়া
নব বসন্তে এসেছে নবীন ভূপতি।
তরুণ আশার সোনার প্রতিমা বন্দিয়া
নব আনন্দে ফিরিছে যুবক যুবতী।
বীণার তন্ত্রী আকুল ছন্দে ক্রন্দিয়া
ডাকিছে সবারে আছে যারা দূর প্রবাসে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।

আজিকে সবাই সাজিয়াছে ফুলচন্দনে,
মুক্ত আকাশে যাপিবে জ্যোত্‍‌স্নাযামিনী।
দলে দলে চলে বাঁধাবাঁধি বাহুবন্ধনে---
ধ্বনিছে শূন্যে জয়সংগীতরাগিণী।
নূতন পতাকা নূতন প্রাসাদপ্রাঙ্গণে
দক্ষিণবায়ে উড়িছে বিজয়বিলাসে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।


সারা নিশি ধরে বৃথা করিলাম মন্ত্রণা,
শরত্‍‌-প্রভাত কাটিল শূন্যে চাহিয়া।
বিদায়ের কালে দিতে গেনু কারে সান্ত্বনা,
যাত্রীরা হোথা গেল খেয়াতরী বাহিয়া।
আপনারে শুধু বৃথা করিলাম বঞ্চনা,
জীবন-আহুতি দিলাম কী আশা-হুতাশে!
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।

প্রভাতে আমায় ডেকেছিল সবে ইঙ্গিতে,
বহুজনমাঝে লয়েছিল মোরে বাছিয়া---
যবে রাজপথ ধ্বনিয়া উঠিল সংগীতে
তখনো বারেক উঠেছিল প্রাণ নাচিয়া।
এখন কি আর পারিব প্রাচীর লঙ্ঘিতে---
দাঁড়ায়ে বাহিরে ডাকিব কাহারে বৃথা সে!
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।

তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে
অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে।
দীর্ঘ ভ্রমণ একদিন হবে অন্ত রে,
শান্তিসমীর শ্রান্ত শরীর জুড়াবে।
দুয়ার-প্রান্তে দাঁড়ায়ে বাহির-প্রান্তরে
ভেরী বাজাইব মোর প্রাণপণ প্রয়াসে!
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি---
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিছে আকাশে।






 #29

অস্পষ্ট 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজি ফাল্গুনে দোলপূর্ণিমারাত্রি,
উপছায়া-চলা বনে বনে মন
আবছা পথের যাত্রী।
ঘুম-ভাঙানিয়া জোছনা--
কোথা থেকে যেন আকাশে কে বলে,
"একটুকু কাছে বোসো না।'
ফিস্‌ফিস্‌ করে পাতায় পাতায়,
উস্‌খুস্‌ করে হাওয়া।
ছায়ার আড়ালে গন্ধরাজের
তন্দ্রাজড়িত চাওয়া।
চন্দনিদহে থইথই জল
ঝিক্‌ঝিক্‌ করে আলোতে,
জামরুলগাছে ফুলকাটা কাজে
বুনুনি সাদায় কালোতে।
প্রহরে প্রহরে রাজার ফটকে
বহুদূরে বাজে ঘণ্টা।
জেগে উঠে বসে ঠিকানা-হারানো
শূন্য-উধাও মনটা।
বুঝিতে পারি নে কত কী শব্দ--
মনে হয় যেন ধারণা,
রাতের বুকের ভিতরে কে করে
অদৃশ্য পদচারণা।
গাছগুলো সব ঘুমে ডুবে আছে,
তন্দ্রা তারায় তারায়,
কাছের পৃথিবী স্বপ্নপ্লাবনে
দূরের প্রান্তে হারায়।
রাতের পৃথিবী ভেসে উঠিয়াছে
বিধির নিশ্চেতনায়,
আভাস আপন ভাষার পরশ
খোঁজে সেই আনমনায়।
রক্তের দোলে যে-সব বেদনা
স্পষ্ট বোধের বাহিরে
ভাবনাপ্রবাহে বুদ্‌বুদ্‌ তারা,
স্থির পরিচয় নাহি রে।
প্রভাত-আলোক আকাশে আকাশে
এ চিত্র দিবে মুছিয়া,
পরিহাসে তব অবচেতনার
বঞ্চনা যাবে ঘুচিয়া।
চেতনার জালে এ মহাগহনে
বস্তু যা-কিছু টিঁকিবে,
সৃষ্টি তারেই স্বীকার করিয়া
স্বাক্ষর তাহে লিখিবে।
তবু কিছু মোহ, কিছু কিছু ভুল
জাগ্রত সেই প্রাপণার
প্রাণতন্তুতে রেখায় রেখায়
রঙ রেখে যাবে আপনার।
এ জীবনে তাই রাত্রির দান
দিনের রচনা জড়ায়ে
চিন্তা-কাজের ফাঁকে ফাঁকে সব
রয়েছে ছড়ায়ে ছড়ায়ে।
বুদ্ধি যাহারে মিছে বলে হাসে
সে যে সত্যের মূলে
আপন গোপন রসসঞ্চারে
ভরিছে ফসলে ফুলে।
অর্থ পেরিয়ে নিরর্থ এসে
ফেলিছে রঙিন ছায়া--
বাস্তব যত শিকল গড়িছে,
খেলেনা গড়িছে মায়া।


 #30

আকাশ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শিশুকালের থেকে
আকাশ আমার মুখে চেয়ে একলা গেছে ডেকে।


দিন কাটত কোণের ঘরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা
কাছের দিকে সর্বদা মুখ-ফেরা;
তাই সুদূরের পিপাসাতে
অতৃপ্ত মন তপ্ত ছিল। লুকিয়ে যেতেম ছাতে,
চুরি করতেম আকাশভরা সোনার বরন ছুটি,
নীল অমৃতে ডুবিয়ে নিতেম ব্যাকুল চক্ষু দুটি।
দুপুর রৌদ্রে সুদূর শূন্যে আর কোনো নেই পাখি,
কেবল একটি সঙ্গীবিহীন চিল উড়ে যায় ডাকি
নীল অদৃশ্যপানে;
আকাশপ্রিয় পাখি ওকে আমার হৃদয় জানে।
স্তব্ধ ডানা প্রখর আলোর বুকে
যেন সে কোন্‌ যোগীর ধেয়ান মুক্তি-অভিমুখে।
তীক্ষ্ণ তীব্র সুর
সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্ম হয়ে দূরের হতে দূর
ভেদ করে যায় চলে
বৈরাগী ঐ পাখির ভাষা মন কাঁপিয়ে তোলে।


আলোর সঙ্গে আকাশ যেথায় এক হয়ে যায় মিলে
শুভ্রে এবং নীলে
তীর্থ আমার জেনেছি সেইখানে
অতল নীরবতার মাঝে অবগাহনস্নানে।
আবার যখন ঝঞ্ঝা, যেন প্রকাণ্ড এক চিল
এক নিমেষে ছোঁ মেরে নেয় সব আকাশের নীল,
দিকে দিকে ঝাপটে বেড়ায় স্পর্ধাবেগের ডানা,
মানতে কোথাও চায় না কারো মানা,
বারে বারে তড়িৎশিখার চঞ্চু-আঘাত হানে
অদৃশ্য কোন্‌ পিঞ্জরটার কালো নিষেধপানে,
আকাশে আর ঝড়ে
আমার মনে সব-হারানো ছুটির মূর্তি গড়ে।
তাই তো খবর পাই--
শান্তি সেও মুক্তি, আবার অশান্তিও তাই।






 #31

আকাশতলে উঠল ফুটে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আকাশতলে উঠল ফুটে
আলোর শতদল।
পাপড়িগুলি থরে থরে
ছড়ালো দিক্-দিগন্তরে,
ঢেকে গেলো অন্ধকারের
নিবিড় কালো জল।
মাঝখানেতে সোনার কোষে
আনন্দে, ভাই, আছি বসে -
আমায় ঘিরে ছড়ায় ধীরে
আলোর শতদল।

আকাশেতে ঢেউ দিয়ে রে
বাতাস বহে যায়।
চার দিকে গান বেজে ওঠে,
চার দিকে প্রাণ নেচে ছোটে,
গগনভরা পরশখানি
লাগে সকল গায়।
ডুব দিয়ে এই প্রাণ-সাগরে
নিতেছি প্রাণ বক্ষ ভরে,
ফিরে ফিরে আমায় ঘিরে
বাতাস বহে যায়।

দশ দিকেতে আঁচল পেতে
কোল দিয়েছে মাটি।
রয়েছে জীব যে যেখানে
সকলকে সে ডেকে আনে,
সবার হাতে সবার পাতে
অন্ন সে দেয় বাঁটি।
ভরেছে মন গীত গন্ধে,
বসে আছি মহানন্দে,
আমায় ঘিরে আঁচল পেতে
কোল দিয়েছে মাটি।

আলো, তোমায় নমি, আমার
মিলাক অপরাধ।
ললাটেতে রাখো আমার
পিতার আশীর্বাদ।
বাতাস, তোমায় নমি, আমার
ঘুচুক অবসাদ।
সকল দেহে বুলিয়ে দাও
পিতার আশীর্বাদ।
মাটি, তোমায় নমি, আমার
মিটুক সর্ব সাধ।
গৃহ ভরে ফলিয়ে তোলো
পিতার আশীর্বাদ।


পৌষ ১৩১৬
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৪৮






 #32

আকাশপ্রদীপ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


গোধূলিতে নামল আঁধার ,
ফুরিয়ে গেল বেলা ,
ঘরের মাঝে সাঙ্গ হল
চেনা মুখের মেলা ।
দূরে তাকায় লক্ষ্যহারা
নয়ন ছলোছলো ,
এবার তবে ঘরের প্রদীপ
বাইরে নিয়ে চলো ।
মিলনরাতে সাক্ষী ছিল যারা
আজো জ্বলে আকাশে সেই তারা ।
পাণ্ডু-আঁধার বিদায়রাতের শেষে
যে তাকাত শিশিরসজল শূন্যতা-উদ্দেশে
সেই তারকাই তেমনি চেয়েই আছে
অস্তলোকের প্রান্তদ্বারের কাছে ।
অকারণে তাই এ প্রদীপ জ্বালাই আকাশ-পানে —
যেখান হতে স্বপ্ন নামে প্রাণে ।


 #33

আকাশে চেয়ে দেখি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আকাশে চেয়ে দেখি
অবকাশের অন্ত নেই কোথাও।
দেশকালের সেই সুবিপুল আনুকূল্যে
তারায় তারায় নিঃশব্দ আলাপ,
তাদের দ্রুতবিচ্ছুরিত আলোক-সংকেতে
তপস্বিনী নীরবতার ধ্যান কম্পমান।
অসংখ্যের ভারে পরিকীর্ণ আমার চিত্ত;
চারদিকে আশু প্রয়োজনের কাঙালের দল;
অসীমের অবকাশকে খণ্ড খণ্ড করে
ভিড় করেছে তারা
উৎকণ্ঠ কোলাহলে।
সংকীর্ণ জীবনে আমার স্বর তাই বিজড়িত,
সত্য পৌঁছয় না অনুজ্জ্বল বাণীতে।
প্রতিদিনের অভ্যস্ত কথার
মূল্য হল দীন;
অর্থ গেল মুছে।
আমার ভাষা যেন
কুয়াশার জড়িমায় অবমানিত
হেমন্তের বেলা,
তার সুর পড়েছে চাপা।
সুস্পষ্ট প্রভাতের মতো
মন অনায়াসে মাথা তুলে বলতে পারে না--
"ভালোবাসি।"
সংকোচ লাগে কণ্ঠের কৃপণতায়।
তাই ওগো বনস্পতি,
তোমার সম্মুখে এসে বসি সকালে বিকালে,
শ্যামচ্ছায়ায় সহজ করে নিতে চাই
আমার বাণী।
দেখি চেয়ে, তোমার পল্লবস্তবক
অনায়াসে পার হয়েছে
শাখাব্যূহের জটিলতা,
জয় করে নিয়েছে চারদিকে নিস্তব্ধ অবকাশ।
তোমার নিঃশব্দ উচ্ছ্বাস সেই উদার পথে
উত্তীর্ণ হয়ে যায়
সূর্যোদয়-মহিমার মাঝে।
সেই পথ দিয়ে দক্ষিণ বাতাসের স্রোতে
অনাদি প্রাণের মন্ত্র
তোমার নবকিশলয়ের মর্মে এসে মেলে--
বিশ্বহৃদয়ের সেই আনন্দমন্ত্র--
"ভালোবাসি।"
বিপুল ঔৎসুক্য আমাকে বহন করে নিয়ে যায়
সুদূরে;
বর্তমান মুহূর্তগুলিকে
অবলুপ্ত করে কালহীনতায়।
যেন কোন্‌ লোকান্তরগত চক্ষু
জন্মান্তর থেকে চেয়ে থাকে
অমার মুখের দিকে,--
চেতনাকে নিষ্কারণ বেদনায়
সকল সীমার পরপারে দেয় পাঠিয়ে।
ঊর্ধ্বলোক থেকে কানে আসে
সৃষ্টির শাশ্বতবাণী--
"ভালোবাসি।"
যেদিন যুগান্তের রাত্রি হল অবসান
আলোকের রশ্মিদূত
বিকীর্ণ করেছিল এই আদিমবাণী
আকাশে আকাশে।
সৃষ্টিযুগের প্রথম লগ্নে
প্রাণসমুদ্রের মহাপ্লাবনে
তরঙ্গে তরঙ্গে দুলেছিল এই মন্ত্র-বচন।
এই বাণীই দিনে দিনে রচনা করেছে
স্বর্ণচ্ছটায় মানসী প্রতিমা
আমার বিরহ-গগনে
অস্তসাগরের নির্জন ধূসর উপকূলে।
আজ দিনান্তের অন্ধকারে
এজন্মের যত ভাবনা যত বেদনা
নিবিড় চেতনায় সম্মিলিত হয়ে
সন্ধ্যাবেলার একলা তারার মতো
জীবনের শেষবাণীতে হোক উদ্ভাসিত--
"ভালোবাসি।"






 #34

আকাশের চাঁদ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ —
এই হল তার বুলি।
দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া,
কাঁদে সে দু হাত তুলি।
হাসিছে আকাশ, বহিছে বাতাস,
পাখিরা গাহিছে সুখে।
সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে,
বিকালে ঘরের মুখে।
বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে
খেলিছে আঙিনা-কোণে,
কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী
হাসিছে আপন মনে।
কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়
চলেছে যে যার কাজে —
কত জনরব কত কলরব
উঠিছে আকাশমাঝে।
পথিকেরা এসে তাহারে শুধায় ,
'কে তুমি কাঁদিছ বসি । '
সে কেবল বলে নয়নের জলে,
'হাতে পাই নাই শশী।'

সকালে বিকালে ঝরি পড়ে কোলে
অযাচিত ফুলদল,
দখিন সমীর বুলায় ললাটে
দক্ষিণ করতল।
প্রভাতের আলো আশিস-পরশ
করিছে তাহার দেহে,
রজনী তাহারে বুকের আঁচলে
ঢাকিছে নীরব স্নেহে।
কাছে আসি শিশু মাগিছে আদর
কণ্ঠ জড়ায়ে ধরি,
পাশে আসি যুবা চাহিছে তাহারে
লইতে বন্ধু করি।
এই পথে গৃহে কত আনাগোনা,
কত ভালোবাসাবাসি,
সংসারসুখ কাছে কাছে তার
কত আসে যায় ভাসি,
মুখ ফিরাইয়া সে রহে বসিয়া,
কহে সে নয়নজলে,
'তোমাদের আমি চাহি না কারেও,
শশী চাই করতলে।'

শশী যেথা ছিল সেথাই রহিল,
সেও ব'সে এক ঠাঁই।
অবশেষে যবে জীবনের দিন
আর বেশি বাকি নাই,
এমন সময়ে সহসা কী ভাবি
চাহিল সে মুখ ফিরে
দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর
সুনীল সিন্ধুতীরে।
সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া
কাটিতেছে পাকা ধান,
ছোটো ছোটো তরী পাল তুলে যায়,
মাঝি বসে গায় গান।
দূরে মন্দিরে বাজিছে কাঁসর,
বধূরা চলেছে ঘাটে,
মেঠো পথ দিয়ে গৃহস্থ জন
আসিছে গ্রামের হাটে।
নিশ্বাস ফেলি রহে আঁখি মেলি,
কহে ম্রিয়মাণ মন,
'শশী নাহি চাই যদি ফিরে পাই
আর বার এ জীবন।'

দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ
সুন্দর লোকালয়
প্রতি দিবসের হরষে বিষাদে
চির-কল্লোলময়।
স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী
ফিরিছে গৃহের মাঝে,
প্রতি দিবসেরে করিছে মধুর
প্রতি দিবসের কাজে।
সকাল বিকাল দুটি ভাই আসে
ঘরের ছেলের মতো,
রজনী সবারে কোলেতে লইছে
নয়ন করিয়া নত।
ছোটো ছোটো ফুল, ছোটো ছোটো হাসি,
ছোটো কথা, ছোটো সুখ,
প্রতি নিমেষের ভালোবাসাগুলি,
ছোটো ছোটো হাসিমুখ
আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া
মানবজীবন ঘিরি,
বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই
দেখিতেছে ফিরি ফিরি।

দেখে বহুদূরে ছায়াপুরী-সম
অতীত জীবন-রেখা,
অস্তরবির সোনার কিরণে
নূতন বরনে লেখা।
যাহাদের পানে নয়ন তুলিয়া
চাহে নি কখনো ফিরে,
নবীন আভায় দেখা দেয় তারা
স্মৃতিসাগরের তীরে।
হতাশ হৃদয়ে কাঁদিয়া কাঁদিয়া
পুরবীরাগিণী বাজে,
দু-বাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়
ওই জীবনের মাঝে।
দিনের আলোক মিলায়ে আসিল
তবু পিছে চেয়ে রহে—
যাহা পেয়েছিল তাই পেতে চায়
তার বেশি কিছু নহে।
সোনার জীবন রহিল পড়িয়া
কোথা সে চলিল ভেসে।
শশীর লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি
রবিশশীহীন দেশে।






 #35

আকুল আহ্বান 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অভিমান ক'রে কোথায় গেলি,
আয় মা ফিরে, আয় মা ফিরে আয়।
দিন রাত কেঁদে কেঁদে ডাকি
আয় মা ফিরে, আয় মা ফিরে আয়।
সন্ধে হল, গৃহ অন্ধকার,
মা গো, হেথায় প্রদীপ জ্বলে না।
একে একে সবাই ঘরে এল,
আমায় যে মা, "মা' কেউ বলে না।
সময় হল বেঁধে দেব চুল,
পরিয়ে দেব রাঙা কাপড়খানি।
সাঁজের তারা সাঁজের গগনে --
কোথায় গেল, রানী আমার রানী!


ও মা, রাত হল, আঁধার করে আসে,
ঘরে ঘরে প্রদীপ নিবে যায়।
আমার ঘরে ঘুম নেইকো শুধু --
শূন্য শেজ শূন্যপানে চায়।
কোথায় দুটি নয়ন ঘুমে ভরা,
সেই নেতিয়ে-পড়া ঘুমিয়ে-পড়া মেয়ে।
শ্রান্ত দেহ ঢুলে ঢুলে পড়ে,
তবু মায়ের তরে আছে বুঝি চেয়ে।


আঁধার রাতে চলে গেলি তুই,
আঁধার রাতে চুপি চুপি আয়।
কেউ তো তোরে দেখতে পাবে না,
তারা শুধু তারার পানে চায়।
পথে কোথাও জনপ্রাণী নেই,
ঘরে ঘরে সবাই ঘুমিয়ে আছে।
মা তোর শুধু একলা দ্বারে বসে,
চুপি চুপি আয় মা, মায়ের কাছে।
আমি তোরে নুকিয়ে রেখে দেব,
রেখে দেব বুকের মধ্যে করে --
থাক্‌, মা, সে তার পাষাণ হৃদি নিয়ে
অনাদর যে করেছে তোরে।
মলিন মুখে গেলি তাদের কাছে --
তবু তারা নিলে না মা কোলে?
বড়ো বড়ো আঁখি দুখানি
রইলি তাদের মুখের পানে তুলে?
এ জগৎ কঠিন -- কঠিন --
কঠিন, শুধু মায়ের প্রাণ ছাড়া।
সেইখানে তুই আয় মা ফিরে আয় --
এত ডাকি দিবি নে কি সাড়া?


হে ধরণী, জীবের জননী,
শুনেছি যে মা তোমায় বলে।
তবে কেন তোর কোলে সবে
কেঁদে আসে কেঁদে যায় চলে।
তবে কেন তোর কোলে এসে
সন্তানের মেটে না পিপাসা।
কেন চায় -- কেন কাঁদে সবে,
কেন কেঁদে পায় না ভালোবাসা।
কেন হেথা পাষাণ পরান
কেন সবে নীরস নিষ্ঠুর!
কেঁদে কেঁদে দুয়ারে যে আসে
কেন তারে করে দেয় দূর!
কেঁদে যে-জন ফিরে চলে যায়,
তার তরে কাঁদিস নে কেহ --
এই কি মা জননীর প্রাণ!
এই কি মা জননীর স্নেহ!


ফুলের দিনে সে যে চলে গেল,
ফুল ফোটা সে দেখে গেল না।
ফুলে ফুলে ভরে গেল বন,
একটি সে তো পরতে পেল না।
ফুল ফোটে, ফুল ঝরে যায় --
ফুল নিয়ে আর সবাই পরে।
ফিরে এসে সে যদি দাঁড়ায়,
একটিও রবে না তার তরে!
তার তরে মা কেবল আছে,
আছে শুধু জননীর স্নেহ,
আছে শুধু মা'র অশ্রুজল --
কিছু নাই, নাই আর কেহ।
খেলত যারা তারা খেলতে গেছে,
হাসত যারা তারা আজও হাসে,
তার তরে কেহ ব'সে নেই,
মা শুধু রয়েছে তারি আশে!


হায় বিধি, এ কি ব্যর্থ হবে!
ব্যর্থ হবে মা'র ভালোবাসা!
কত জনের কত আশা পুরে,
ব্যর্থ হবে মার প্রাণের আশা!






 #36

আগমনী 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


সুধীরে নিশার আঁধার ভেদিয়া
ফুটিল প্রভাততারা।
হেথা হোথা হতে পাখিরা গাহিল
ঢালিয়া সুধার ধারা।
মৃদুল প্রভাতসমীর পরশে
কমল নয়ন খুলিল হরষে,
হিমালয় শিরে অমল আভায়
শোভিল ধবল তুষারজটা।
খুলি গেল ধীরে পূরবদ্বার,
ঝরিল কনককিরণধার,
শিখরে শিখরে জ্বলিয়া উঠিল,
রবির বিমল কিরণছটা।
গিরিগ্রাম আজি কিসের তরে,
উঠেছে নাচিয়া হরষভরে,
অচল গিরিও হয়েছে যেমন
অধীর পাগল-পারা।
তটিনী চলেছে নাচিয়া ছুটিয়া,
কলরব উঠে আকাশে ফুটিয়া ,
ঝর ঝর ঝর করিয়া ধ্বনি
ঝরিছে নিঝরধারা।
তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া মালা,
চলিয়াছে গিরিবাসিনী বালা,
অধর ভরিয়া সুখের হাসিতে
মাতিয়া সুখের গানে।
মুখে একটিও নাহিকো বাণী
শবদচকিতা মেনকারানী
তৃষিত নয়নে আকুল হৃদয়ে,
চাহিয়া পথের পানে।
আজ মেনকার আদরিণী উমা
আসিবে বরষ-পরে।
তাইতে আজিকে হরষের ধ্বনি
উঠিয়াছে ঘরে ঘরে।
অধীর হৃদয়ে রানী আসে যায়,
কভু বা প্রাসাদশিখরে দাঁড়ায়,
কভু বসে ওঠে, বাহিরেতে ছোটে
এখনো উমা মা এলনা কেন?
হাসি হাসি মুখে পুরবাসীগণে
অধীরে হাসিয়া ভূধরভবনে,
"কই উমা কই' বলে "উমা কই',
তিলেক বেয়াজ সহে না যেন!
বরষের পরে আসিবেন উমা
রানীর নয়নতারা ,
ছেলেবেলাকার সহচরী যত
হরষে পাগল-পারা।
ভাবিছে সকলে আজিকে উমায়
দেখিবে নয়ন ভ'রে,
আজিকে আবার সাজাব তাহায়
বালিকা উমাটি ক'রে।
তেমনি মৃণালবলয়-যুগলে,
তেমনি চিকন-চিকন বাকলে,
তেমনি করিয়া পরাব গলায়
বনফুল তুলি গাঁথিয়া মালা।
তেমনি করিয়া পরায়ে বেশ
তেমনি করিয়া এলায়ে কেশ,
জননীর কাছে বলিব গিয়ে
"এই নে মা তোর তাপসী বালা'।
লাজ-হাসি-মাখা মেয়ের মুখ
হেরি উথলিবে মায়ের সুখ,
হরষে জননী নয়নের জলে
চুমিবে উমার সে মুখখানি।
হরষে ভূধর অধীর-পারা
হরষে ছুটিবে তটিনীধারা,
হরষে নিঝর উঠিবে উছসি,
উঠিবে উছসি মেনকারানী।
কোথা তবে তোরা পুরবাসী মেয়ে
যেথা যে আছিস আয় তোরা ধেয়ে
বনে বনে বনে ফিরিবি বালা,
তুলিবি কুসুম, গাঁথিবি মালা,
পরাবি উমার বিনোদ গলে।
তারকা-খচিত গগন-মাঝে
শারদ চাঁদিমা যেমন সাজে
তেমনি শারদা অবনী শশী
শোভিবে কেমন অবনীতলে!
ওই বুঝি উমা, ওই বুঝি আসে,
দেখো চেয়ে গিরিরানী!
আলুলিত কেশ, এলোথেলো বেশ,
হাসি-হাসি মুখখানি।
বালিকারা সব আসিল ছুটিয়া
দাঁড়াল উমারে ঘিরি।
শিথিল চিকুরে অমল মালিকা
পরাইয়া দিল ধীরি।
হাসিয়া হাসিয়া কহিল সবাই
উমার চিবুক ধ'রে,
"বলি গো স্বজনী, বিদেশে বিজনে
আছিলি কেমন করে?
আমরা তো সখি সারাটি বরষ
রহিয়াছি পথ চেয়ে --
কবে আসিবেক আমাদের সেই
মেনকারানীর মেয়ে!
এই নে, সজনী, ফুলের ভূষণ
এই নে, মৃণাল বালা,
হাসিমুখখানি কেমন সাজিবে
পরিলে কুসুম-মালা।'
কেহ বা কহিল,"এবার স্বজনি,
দিব না তোমায় ছেড়ে
ভিখারি ভবের সর্বস্ব ধন
আমরা লইব কেড়ে।
বলো তো স্বজনী, এ কেমন ধারা
এয়েছ বরষ-পরে,
কেমনে নিদিয়া রহিবে কেবল
তিনটি দিনের তরে।'
কেহ বা কহিল,"বলো দেখি,সখী,
মনে পড়ে ছেলেবেলা?
সকলে মিলিয়া এ গিরিভবনে
কত-না করেছি খেলা!
সেই মনে পড়ে যেদিন স্বজনী
গেলে তপোবন-মাঝে--
নয়নের জলে আমরা সকলে
সাজানু তাপসী-সাজে।
কোমল শরীরে বাকল পরিয়া
এলায়ে নিবিড় কেশ
লভিবারে পতি মনের মতন
কত-না সহিলে ক্লেশ।
ছেলেবেলাকার সখীদের সব
এখনো তো মনে আছে,
ভয় হয় বড়ো পতির সোহাগে
ভুলিস তাদের পাছে!'
কত কী কহিয়া হরষে বিষাদে
চলিল আলয়-মুখে,
কাঁদিয়া বালিকা পড়িল ঝাঁপায়ে
আকুল মায়ের বুকে।
হাসিয়া কাঁদিয়া কহিল রানী,
চুমিয়া উমার অধরখানি,
"আয় মা জননি আয় মা কোলে,
আজ বরষের পরে।
দুখিনী মাতার নয়নের জল
তুই যদি, মা গো, না মুছাবি বল্‌
তবে উমা আর ,কে আছে আমার
এ শূন্য আঁধার ঘরে?
সারাটি বরষ যে দুখে গিয়াছে
কী হবে শুনে সে ব্যথা,
বল্‌ দেখি, উমা, পতির ঘরের
সকল কুশল-কথা।'
এত বলি রানী হরষে আদরে
উমারে কোলেতে লয়ে,
হরষের ধারা বরষি নয়নে
পশিল গিরি-আলয়ে।
আজিকে গিরির প্রাসাদে কুটিরে
উঠিল হরষ-ধ্বনি,
কত দিন পরে মেনকা-মহিষী
পেয়েছে নয়নমণি!






 #37

আছে আমার হৃদয় আছে ভরে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ' অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।

এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল' হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল' দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর'।



রেলপথ। ই.আই.আর.
২১ আষাঢ় ১৩১৭

কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা


 #38

আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়
লুকোচুরির খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে
সাদা মেঘের ভেলা।
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,
উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
আজ কিসের তরে নদীর চরে
চখাচখির মেলা।

ওরে যাবো না আজ ঘরে রে ভাই,
যাবো না আজ ঘরে!
ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ
নেব রে লুঠ করে।
যেন জোয়ার জলে ফেনার রাশি
বাতাসে আজ ফুটেছে হাসি,
আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি
কাটবে সারা বেলা।



সালঃ ১৩১৩
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৮






 #39

আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি
মনে হয় এ যেন আমার প্রথম দেখা।
আমি দেখলেম নবীনকে,
প্রতিদিনের ক্লান্ত চোখ
যার দর্শন হারিয়েছে।
কল্পনা করছি,--
অনাগত যুগ থেকে
তীর্থযাত্রী আমি
ভেসে এসেছি মন্ত্রবলে।
উজান স্বপ্নের স্রোতে
পৌঁছলেম এই মুহূর্তেই
বর্তমান শতাব্দীর ঘাটে।
কেবলি তাকিয়ে আছি উৎসুক চোখে।
আপনাকে দেখছি আপনার বাইরে,--
অন্যযুগের অজানা আমি
অভ্যস্ত পরিচয়ের পরপারে।
তাই তাকে নিয়ে এত গভীর কৌতূহল।
যার দিকে তাকাই
চক্ষু তাকে আঁকড়িয়ে থাকে
পুষ্পলগ্ন ভ্রমরের মতো।
আমার নগ্নচিত্ত আজ মগ্ন হয়েছে
সমস্তের মাঝে।
জনশ্রুতির মলিন হাতের দাগ লেগে
যার রূপ হয়েছে অবলুপ্ত,
যা পরেছে তুচ্ছতার মলিন চীর
তার সে জীর্ণ উত্তরীয় আজ গেল খ'সে।
দেখা দিল সে অস্তিত্বের পূর্ণ মূল্যে।
দেখা দিল সে অনির্বচনীয়তায়।
যে বোবা আজ পর্যন্ত ভাষা পায়নি
জগতের সেই অতি প্রকাণ্ড উপেক্ষিত
আমার সামনে খুলেছে তার অচল মৌন,
ভোর-হয়ে-ওঠা বিপুল রাত্রির প্রান্তে
প্রথম চঞ্চল বাণী জাগল যেন।
আমার এতকালের কাছের জগতে
আমি ভ্রমণ করতে বেরিয়েছি দূরের পথিক।
তার আধুনিকের ছিন্নতার ফাঁকে ফাঁকে
দেখা দিয়েছে চিরকালের রহস্য।
সহমরণের বধূ
বুঝি এমনি ক'রেই দেখতে পায়
মৃত্যুর ছিন্নপর্দার ভিতর দিয়ে
নূতন চোখে
চিরজীবনের অম্লান স্বরূপ।






 #40
আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি
প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ;
আপন আগুনে শোক দগ্ধ করি দিল আপনারে
উঠিল প্রদীপ্ত হয়ে।
সায়াহ্নবেলার ভালে অস্তসূর্য দেয় পরাইয়া
রক্তোজ্জল মহিমার টিকা,
স্বর্ণময়ী করে দেয় আসন্ন রাত্রির মুখশ্রীরে,
তেমনি জ্বলন্ত শিখা মৃত্যু পরাইল মোরে
জীবনের পশ্চিমসীমায়।
আলোকে তাহার দেখা দিল
অখন্ড জীবন, যাহে জন্মমৃত্যু এক হয়ে আছে;
সে মহিমা উদ্‌বারিল যাহার উজ্জ্বল অমরতা
কৃপণ ভাগ্যের দৈন্যে দিনে দিনে রেখেছিল ঢেকে।






 #41
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
এই সংগীতমুখরিত গগনে
তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহিরভূবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।

অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে
আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে -
দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া
আজি ব্যকুল বসুন্ধরা সাজে রে।
মোর পরানে দখিন বায়ু লাগিছে,
কারে দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে,
এই সৌরভবিহবল রজনী
কার চরণে ধরণীতলে জাগিছে।
ওগো সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,
তব গম্ভীর আহবান কারে।



বোলপুর
২৬ চৈত্র ১৩১৬

কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৫৫






 #42
আজু সখি মুহু মুহু 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজু সখি , মুহু মুহু
গাহে পিক কুহু কুহু ,
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু
দোঁহার পানে চায় ।
যুবনমদবিলসিত
পুলকে হিয়া উলসিত ,
অবশ তনু অলসিত
মূরছি জনু যায় ।
আজু মধু চাঁদনী
প্রাণউনমাদনী ,
শিথিল সব বাঁধনী ,
শিথিল ভই লাজ ।
বচন মৃদু মরমর,
কাঁপে রিঝ থরথর ,
শিহরে তনু জরজর
কুসুমবনমাঝ ।
মলয় মৃদু কলয়িছে ,
চরণ নহি চলয়িছে ,
বচন মুহু খলয়িছে ,
অঞ্চল লুটায় ।
আধফুট শতদল
বায়ুভরে টলমল
আঁখি জনু ঢলঢল
চাহিতে নাহি চায় ।
অলকে ফুল কাঁপয়ি
কপোলে পড়ে ঝাঁপয়ি ,
মধু-অনলে তাপয়ি ,
খসয়ি পড়ু পায় ।
ঝরই শিরে ফুলদল ,
যমুনা বহে কলকল ,
হাসে শশি ঢলঢল —
ভানু মরি যায় ।






 #43
আতার বিচি 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আতার বিচি নিজে পুঁতে পাব তাহার ফল,
দেখব ব'লে ছিল মনে বিষম কৌতূহল।
তখন আমার বয়স ছিল নয়,
অবাক লাগত কিছুর থেকে কেন কিছুই হয়।
দোতলাতে পড়ার ঘরের বারান্দাটা বড়ো,
ধুলো বালি একটা কোণে করেছিলুম জড়ো।
সেথায় বিচি পুঁতেছিলুম অনেক যত্ন করে,
গাছ বুঝি আজ দেখা দেবে, ভেবেছি রোজ ভোরে।
জানলাটার পূর্বধারে টেবিল ছিল পাতা,
সেইখানেতে পড়া চলত; পুঁথিপত্র খাতা
রোজ সকালে উঠত জমে দুর্ভাবনার মতো;
পড়া দিতেন, পড়া নিতেন মাস্টার মন্মথ।
পড়তে পড়তে বারে বারে চোখ যেত ঐ দিকে,
গোল হত সব বানানেতে, ভুল হত সব ঠিকে।
অধৈর্য অসহ্য হত, খবর কে তার জানে
কেন আমার যাওয়া-আসা ঐ কোণটার পানে।
দু মাস গেল, মনে আছে, সেদিন শুক্রবার--
অঙ্কুরটি দেখা দিল নবীন সুকুমার।
অঙ্ক-কষার বারান্দাতে চুনসুরকির কোণে
অপূর্ব সে দেখা দিল, নাচ লাগালো মনে।
আমি তাকে নাম দিয়েছি আতা গাছের খুকু,
ক্ষণে ক্ষণে দেখতে যেতেম, বাড়ল কতটুকু।
দুদিন বাদেই শুকিয়ে যেত সময় হলে তার,
এ জায়গাতে স্থান নাহি ওর করত আবিষ্কার;
কিন্তু যেদিন মাস্টার ওর দিলেন মৃত্যুদণ্ড,
কচিকচি পাতার কুঁড়ি হল খণ্ড খণ্ড,
আমার পড়ার ত্রুটির জন্যে দায়ী করলেন ওকে,
বুক যেন মোর ফেটে গেল, অশ্রু ঝরল চোখে।
দাদা বললেন, কী পাগলামি, শান-বাঁধানো মেঝে,
হেথায় আতার বীজ লাগানো ঘোর বোকামি এ যে।
আমি ভাবলুম সারা দিনটা বুকের ব্যথা নিয়ে,
বড়োদের এই জোর খাটানো অন্যায় নয় কি এ।
মূর্খ আমি ছেলেমানুষ, সত্য কথাই সে তো,
একটু সবুর করলেই তা আপনি ধরা যেত।






 #44
আমগাছ 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এ তো সহজ কথা ,
অঘ্রানে এই স্তব্ধ নীরবতা
জড়িয়ে আছে সামনে আমার
আমের গাছে ;
কিন্তু ওটাই সবার চেয়ে
দুর্গম মোর কাছে ।
বিকেল বেলার রোদ্‌দুরে এই চেয়ে থাকি ,
যে রহস্য ওই তরুটি রাখল ঢাকি
গুঁড়িতে তার ডালে ডালে
পাতায় পাতায় কাঁপনলাগা তালে
সে কোন্‌ ভাষা আলোর সোহাগ
শূন্যে বেড়ায় খুঁজি ।
মর্ম তাহার স্পষ্ট নাহি বুঝি ,
তবু যেন অদৃশ্য তার চঞ্চলতা
রক্তে জাগায় কানে-কানে কথা ,
মনের মধ্যে বুলায় যে অঙ্গুলি
আভাস-ছোঁওয়া ভাষা তুলি
সে এনে দেয় অস্পষ্ট ইঙ্গিত
বাক্যের অতীত ।

ওই যে বাকলখানি
রয়েছে ওর পর্দা টানি
ওর ভিতরের আড়াল থেকে আকাশ-দূতের সাথে
বলা - কওয়া কী হয় দিনে রাতে ,
পরের মনের স্বপ্নকথার সম
পৌঁছবে না কৌতূহলে মম ।
দুয়ার-দেওয়া যেন বাসরঘরে
ফুলশয্যার গোপন রাতে কানাকানি করে ,
অনুমানেই জানি ,
আভাসমাত্র না পাই তাহার বাণী ।
ফাগুন আসে বছরশেষের পারে ,
দিনে-দিনেই খবর আসে দ্বারে ।
একটা যেন চাপা হাসি কিসের ছলে
অবাক শ্যামলতার তলে
শিকড় হতে শাখে শাখে
ব্যাপ্ত হয়ে থাকে ।
অবশেষে খুশির দুয়ার হঠাৎ যাবে খুলে
মুকুলে মুকুলে ।


 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা


 #45

আমরা কি সত্যিই চাই শোকের অবসান 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য সুহৃদ্‌বরেষু


আমরা কি সত্যই চাই শোকের অবসান?
আমাদের গর্ব আছে নিজের শোককে নিয়েও।
আমাদের অতি তীব্র বেদনাও
বহন করে না স্থায়ী সত্যকে--
সান্ত্বনা নেই এমন কথায়;
এতে আঘাত লাগে আমাদের দুঃখের অহংকারে।
জীবনটা আপন সকল সঞ্চয়
ছড়িয়ে রাখে কালের চলাচলের পথে;
তার অবিরাম-ধাবিত চাকার তলায়
গুরুতর বেদনার চিহ্নও যায়
জীর্ণ হয়ে, অস্পষ্ট হয়ে।
আমাদের প্রিয়তমের মৃত্যু
একটিমাত্র দাবি করে আমাদের কাছে
সে বলে--"মনে রেখো।"
কিন্তু সংখ্যা নেই প্রাণের দাবির,
তার আহ্বান আসে চারিদিক থেকেই
মনের কাছে;
সেই উপস্থিত কালের ভিড়ের মধ্যে
অতীতকালের একটিমাত্র আবেদন
কখন হয় অগোচর।
যদি বা তার কথাটা থাকে
তার ব্যথাটা যায় চলে।
তবু শোকের অভিমান
জীবনকে চায় বঞ্চিত করতে।
স্পর্ধা ক'রে প্রাণের দূতগুলিকে বলে--
খুলব না দ্বার।
প্রাণের ফসলখেত বিচিত্র শস্যে উর্বর,
অভিমানী শোক তারি মাঝখানে
ঘিরে রাখতে চায় শোকের দেবত্র জমি,--
সাধের মরুভূমি বানায় সেখানটাতে,
তার খাজনা দেয় না জীবনকে।
মৃত্যুর সঞ্চয়গুলি নিয়ে
কালের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ।
সেই অভিযোগে তার হার হতে থাকে দিনে দিনে।
কিন্তু চায় না সে হার মানতে;
মনকে সমাধি দিতে চায়
তার নিজকৃত কবরে।
সকল অহংকারই বন্ধন,
কঠিন বন্ধন আপন শোকের অহংকার।
ধন জন মান সকল আসক্তিতেই মোহ,
নিবিড় মোহ আপন শোকের আসক্তিতে।






 #46

আমাদের ছোট নদী 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।

আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।






 #47

আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু,
নয় তো হীনবল -
শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে
ফেলবে অশ্রুজল।
মন্দমধুর সুখে শোভায়
প্রেম কে কেন ঘুমে ডোবায়।
তোমার সাথে জাগতে সে চায়
আনন্দে পাগল।

নাচ' যখন ভীষণ সাজে
তীব্র তালের আঘাত বাজে,
পালায় ত্রাসে পালায় লাজে
সন্দেহ বিহবল।
সেই প্রচন্ড মনোহরে
প্রেম যেন মোর বরণ করে,
ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার
দিক সে রসাতল।


৪ আষাঢ় ১৩১৭
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৮৯






 #48

আমার এই ছোটো কলসিটা পেতে রাখি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার এই ছোটো কলসিটা পেতে রাখি
ঝরনাধারার নিচে।
বসে থাকি
কোমরে আঁচল বেঁধে,
সারা সকালবেলা,
শেওলা ঢাকা পিছল পাথরটাতে
পা ঝুলিয়ে।
এক নিমেষেই ঘট যায় ভরে
তার পরে কেবলি তার কানা ছাপিয়ে ওঠে,
জল পড়তে থাকে ফেনিয়ে ফেনিয়ে
বিনা কাজে বিনা ত্বরায়;
ঐ যে সূর্যের আলোয়
উপচে-পড়া জলের চলে ছুটির খেলা,
আমার খেলা ঐ সঙ্গেই ছলকে ওঠে
মনের ভিতর থেকে।
সবুজ বনের মিনে-করা
উপত্যকার নীল আকাশের পেয়ালা,
তারি পাহাড়-ঘেরা কানা ছাপিয়ে
পড়ছে ঝরঝরানির শব্দ।
ভোরের ঘুমে তার ডাক শুনতে পায়
গাঁয়ের মেয়েরা।
জলের ধ্বনি
বেগনি রঙের বনের সীমানা যায় পেরিয়ে,
নেমে যায় যেখানে ঐ বুনোপাড়ার মানুষ
হাট করতে আসে,
তরাই গ্রামের রাস্তা ছেড়ে
বাঁকে বাঁকে উঠতে থাকে চড়াই পথ বেয়ে,
তার বলদের গলায়
রুনুঝুনু ঘণ্টা বাজে,
তার বলদের পিঠে
শুকনো কাঠের আঁটি বোঝাই-করা।
এমনি করে
প্রথম প্রহর গেল কেটে।
রাঙা ছিল সকালবেলাকার
নতুন রৌদ্রের রঙ,
উঠল সাদা হয়ে।
বক উড়ে চলেছে পাহাড় পেরিয়ে
জলার দিকে,
শঙ্খচিল উড়ছে একলা
ঘন নীলের মধ্যে,ঊর্ধ্বমুখ পর্বতের উধাও চিত্তে
নিঃশব্দ জপমন্ত্রের মতো।
বেলা হল,
ডাক পড়ল ঘরে।
ওরা রাগ করে বললে,
"দেরি করলি কেন?"
চুপ করে থাকি নিরুত্তরে।
ঘট ভরতে দেরি হয় না
সে তো সবাই জানে;
বিনাকাজে উপচে-পড়া-সময় খোওয়ানো,
তার খাপছাড়া কথা ওদের বোঝাবে কে?






 #49

আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত।।

কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে,
খুশি রই আপন মনে- বাতাস বহে সুমন্দ।
সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা,
শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা।
ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন-মনে,
ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ।।

আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত।
আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।



রচনা: শিলাইদহ ১৭ চৈত্র ১৩১৮
গীতবিতান পূজা ৫৫৯, বিশ্বভারতী ১৩৮০ সং পৃ ২২০ থেকে সংগৃহীত।

পাঠান্তর:
গীতিমাল্যে (রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী ১৩৮৯ সং, খণ্ড ১১, পৃ ১৩৪) পঙ্‌ক্তি ৭ এ 'আপন-মনে' ছিল 'মনে মনে"।






 #50

আমার কাছে শুনতে চেয়েছ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শ্রীমান ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কল্যাণীয়েষু


আমার কাছে শুনতে চেয়েছ
গানের কথা;
বলতে ভয় লাগে,
তবু কিছু বলব।
মানুষের জ্ঞান বানিয়ে নিয়েছে
আপন সার্থক ভাষা।
মানুষের বোধ অবুঝ, সে বোবা,
যেমন বোবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।
সেই বিরাট বোবা
আপনাকে প্রকাশ করে ইঙ্গিতে,
ব্যাখ্যা করে না।
বোবা বিশ্বের আছে ভঙ্গি, আছে ছন্দ,
আছে নৃত্য আকাশে আকাশে।
অণুপরমাণু অসীম দেশে কালে
বানিয়েছে আপন আপন নাচের চক্র,
নাচছে সেই সীমায় সীমায়;
গড়ে তুলছে অসংখ্য রূপ।
তার অন্তরে আছে বহ্নিতেজের দুর্দাম বোধ
সেই বোধ খুঁজছে আপন ব্যঞ্জনা,
ঘাসের ফুল থেকে শুরু ক'রে
আকাশের তারা পর্যন্ত।
মানুষের বোধের বেগ যখন বাঁধ মানে না,
বাহন করতে চায় কথাকে,--
তখন তার কথা হয়ে যায় বোবা,
সেই কথাটা খোঁজে ভঙ্গি, খোঁজে ইশারা,
খোঁজে নাচ, খোঁজে সুর,
দেয় আপনার অর্থকে উলটিয়ে,
নিয়মকে দেয় বাঁকা ক'রে।
মানুষ কাব্যে রচে বোবার বাণী।
মানুষের বোধ যখন বাহন করে সুরকে
তখন বিদ্যুচ্চঞ্চল পরমাণুপুঞ্জের মতোই
সুরসংঘকে বাঁধে সীমায়,
ভঙ্গি দেয় তাকে,
নাচায় তাকে বিচিত্র আবর্তনে।
সেই সীমায়-বন্দী নাচন
পায় গানে-গড়া রূপ।
সেই বোবা রূপের দল মিলতে থাকে।
সৃষ্টির অন্দরমহলে,
সেখানে যত রূপের নটী আছে
ছন্দ মেলায় সকলের সঙ্গে
নূপুর-বাঁধা চাঞ্চল্যের
দোলযাত্রায়।
আমি যে জানি
এ-কথা যে-মানুষ জানায়
বাক্যে হোক সুরে হোক, রেখায় হোক,
সে পণ্ডিত।
আমি যে রস পাই, ব্যথা পাই,
রূপ দেখি,
এ-কথা যার প্রাণ বলে
গান তারি জন্যে,
শাস্ত্রে সে আনাড়ি হলেও
তার নাড়িতে বাজে সুর।
যদি সুযোগ পাও
কথাটা নারদমুনিকে শুধিয়ো,
ঝগড়া বাধাবার জন্যে নয়,
তত্ত্বের পার পাবার জন্যে সংজ্ঞার অতীতে।




রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা

 #51

আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তখন কে তুমি তা কে জানত।
তখন ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,
জীবন বহে যেত অশান্ত।
তুমি ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত
যেন আমার আপন সখার মতো,
হেসে তোমার সাথে ফিরেছিলাম ছুটে
সেদিন কত-না বন-বনান্ত।

ওগো, সেদিন তুমি গাইতে যে সব গান
কোনো অর্থ তাহার কে জানত।
শুধু সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ,
সদা নাচত হৃদয় অশান্ত।
হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি -
স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,
তোমার চরণপানে নয়ন করি নত
ভুবন দাঁড়িয়ে গেছে একান্ত।



১৭ জৈষ্ঠ ১৩১৭

কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৬৮






 #52

আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে
তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে ॥
নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে,
আমার লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে--
অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে ॥
ক্ষণে ক্ষণে আমি না জেনে করেছি দান
তোমায় আমার গান।
পরানের সাজি সাজাই খেলার ফুলে,
জানি না কখন নিজে বেছে লও তুলে--
তুমি অলখ আলোকে নীরবে দুয়ার খুলে
প্রাণের পরশ দিয়ে যাও মোর কাজে ॥






 #53

আমার ফুলবাগানের ফুলগুলিকে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার ফুলবাগানের ফুলগুলিকে
বাঁধব না আজ তোড়ায়,
রঙ-বেরঙের সুতোগুলো থাক্‌,
থাক্‌ পড়ে ঐ জরির ঝালর।
শুনে ঘরের লোকে বলে,
"যদি না বাঁধ জড়িয়ে জড়িয়ে
ওদের ধরব কী করে,
ফুলদানিতে সাজাব কোন্‌ উপায়ে?"
আমি বলি,
"আজকে ওরা ছুটি-পাওয়া নটী,
ওদের উচ্চহাসি অসংযত,
ওদের এলোমেলো হেলাদোলা
বকুলবনে অপরাহ্নে,
চৈত্রমাসের পড়ন্ত রৌদ্রে।
আজ দেখো ওদের যেমন-তেমন খেলা,
শোনো ওদের যখন-তখন কলধ্বনি,
তাই নিয়ে খুশি থাকো।"
বন্ধু বললে,
"এলেম তোমার ঘরে
ভরা পেয়ালার তৃষ্ণা নিয়ে।
তুমি খ্যাপার মতো বললে,
আজকের মতো ভেঙে ফেলেছি
ছন্দের সেই পুরোনো পেয়ালাখানা
আতিথ্যের ত্রুটি ঘটাও কেন?"
আমি বলি, "চলো না ঝরনাতলায়,
ধারা সেখানে ছুটছে আপন খেয়ালে,
কোথাও মোটা, কোথাও সরু।
কোথাও পড়ছে শিখর থেকে শিখরে,
কোথাও লুকোল গুহার মধ্যে।
তার মাঝে মাঝে মোটা পাথর
পথ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বর্বরের মতো,
মাঝে মাঝে গাছের শিকড়
কাঙালের মতো ছড়িয়েছে আঙুলগুলো,
কাকে ধরতে চায় ঐ জলের ঝিকিমিকির মধ্যে?"
সভার লোকে বললে,
"এ যে তোমার আবাঁধা বেণীর বাণী,
বন্দিনী সে গেল কোথায়?"
আমি বলি, "তাকে তুমি পারবে না আজ চিনতে,
তার সাতনলী হারে আজ ঝলক নেই,
চমক দিচ্ছে না চুনি-বসানো কঙ্কণে।"
ওরা বললে, "তবে মিছে কেন?
কী পাবে ওর কাছ থেকে?"
আমি বলি, "যা পাওয়া যায় গাছের ফুলে
ডালে পালায় সব মিলিয়ে।
পাতার ভিতর থেকে
তার রঙ দেখা যায় এখানে সেখানে,
গন্ধ পাওয়া যায় হাওয়ার ঝাপটায়।
চারদিকের খোলা বাতাসে
দেয় একটুখানি নেশা লাগিয়ে।
মুঠোয় করে ধরবার জন্যে সে নয়,
তার অসাজানো আটপহুরে পরিচয়কে
অনাসক্ত হয়ে মানবার জন্যে
তার আপন স্থানে।"






 #54

আমার মাঝে তোমার লীলা হবে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার মাঝে তোমার লীলা হবে,
তাই তো আমি এসেছি এই ভবে।
এই ঘরে সব খুলে যাবে দ্বার,
ঘুচে যাবে সকল অহংকার,
আনন্দময় তোমার এ সংসার
আমার কিছু আর বাকি না রবে।

মরে গিয়ে বাঁচব আমি, তবে
আমার মাঝে তোমার লীলা হবে।
সব বাসনা যাবে আমার থেমে
মিলে গিয়ে তোমারি এক প্রেমে,
দুঃখসুখের বিচিত্র জীবনে
তুমি ছাড়া আর কিছু না রবে।



৭ শ্রাবণ ১৩১৭
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ১৩০






 #55

আমার মিলন লাগি তুমি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।
কত কালের সকাল-সাঁঝে
তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত গৃহ-মাঝে
গেছে আমায় ডেকে।

ওগো পথিক, আজকে আমার
সকল পরাণ ব্যেপে
থেকে থেকে হরষ যেন
উঠছে কেঁপে কেঁপে
যেন সময় এসেছে আজ,
ফুরালো মোর যা ছিল কাজ -
বাতাস আসে, হে মহারাজ,
তোমার গন্ধ মেখে।



১৬ ভাদ্র ১৩১৬
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৩৪






 #56

আমার শেষ বেলাকার ঘরখানি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার শেষবেলাকার ঘরখানি
বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে,
তার নাম দেব শ্যামলী।
ও যখন পড়বে ভেঙে
সে হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতো,
মাটির কোলে মিশবে মাটি;
ভাঙা থামে নালিশ উঁচু করে
বিরোধ করবে না ধরণীর সঙ্গে;
ফাটা দেয়ালের পাঁজর বের ক'রে
তার মধ্যে বাঁধতে দেবে না
মৃতদিনের প্রেতের বাসা।
সেই মাটিতে গাঁথব
আমার শেষ বাড়ির ভিত
যার মধ্যে সব বেদনার বিস্মৃতি,
সব কলঙ্কের মার্জনা,
যাতে সব বিকার সব বিদ্রূপকে
ঢেকে দেয় দূর্বাদলের স্নিগ্ধ সৌজন্যে;
যার মধ্যে শত শত শতাব্দীর
রক্তলোলুপ হিংস্র নির্ঘোষ
গেছে নিঃশব্দ হয়ে।
সেই মাটির ছাদের নিচে বসব আমি
রোজ সকালে শৈশবে যা ভরেছিল
আমার গাঁটবাঁধা চাদরের কোনা
এক-একমুঠো চাঁপা আর বেল ফুলে।
মাঘের শেষে যার আমের বোল
দক্ষিণের হাওয়ায়
অলক্ষ্য দূরের দিকে ছড়িয়েছিল
ব্যথিত যৌবনের আমন্ত্রণ।
আমি ভালোবেসেছি
বাংলাদেশের মেয়েকে;
যে-দেখায় সে আমার চোখ ভুলিয়েছে
তাতে আছে যেন এই মাটির শ্যামল অঞ্জন,
ওর কচি ধানের চিকন আভা।
তাদের কালো চোখের করুণ মাধুরীর উপমা দেখেছি
ঐ মাটির দিগন্তে
নীল বনসীমায় গোধূলির শেষ আলোটির
নিমীলনে।
প্রতিদিন আমার ঘরের সুপ্ত মাটি
সহজে উঠবে জেগে
ভোরবেলাকার সোনার কাঠির
প্রথম ছোঁওয়ায়;
তার চোখ-জুড়ানো শ্যামলিমায়
স্মিত হাসি কোমল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে
চৈত্ররাতের চাঁদের
নিদ্রাহারা মিতালিতে।
চিরদিন মাটি আমাকে ডেকেছে
পদ্মার ভাঙনলাগা
খাড়া পাড়ির বনঝাউবনে,
গাঙশালিকের হাজার খোপের বাসায়;
সর্ষে-তিসির দুইরঙা খেতে
গ্রামের সরু বাঁকা পথের ধারে,
পুকুরের পাড়ির উপরে।
আমার দু-চোখ ভ'রে
মাটি আমায় ডাক পাঠিয়েছে
শীতের ঘুঘুডাকা দুপুরবেলায়,
রাঙা পথের ও পারে,
যেখানে শুকনো ঘাসের হলদে মাঠে
চরে বেড়ায় দুটি-চারটি গোরু
নিরুৎসুক আলস্যে,
লেজের ঘায়ে পিঠের মাছি তাড়িয়ে;
যেখানে সাথীবিহীন
তালগাছের মাথায়
সঙ্গ-উদাসীন নিভৃত চিলের বাসা।
আজ আমি তোমার ডাকে
ধরা দিয়েছি শেষবেলায়।
এসেছি তোমার ক্ষমাস্নিগ্ধ বুকের কাছে,
যেখানে একদিন রেখেছিলে অহল্যাকে,
নবদূর্বাশ্যামলের
করুণ পদস্পর্শে
চরম মুক্তি-জাগরণের প্রতীক্ষায়,
নবজীবনের বিস্মিত প্রভাতে।






 #57

আমি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এই যে সবার সামান্য পথ, পায়ে হাঁটার গলি
সে পথ দিয়ে আমি চলি
সুখে দুঃখে লাভে ক্ষতিতে,
রাতের আঁধার দিনের জ্যোতিতে।
প্রতি তুচ্ছ মুহূর্তেরই আবর্জনা করি আমি জড়ো,
কারো চেয়ে নইকো অমি বড়ো।
চলতে পথে কখনো বা বিঁধছে কাঁটা পায়ে,
লাগছে ধুলো গায়ে;
দুর্বাসনার এলোমেলো হাওয়া,
তারি মধ্যে কতই চাওয়া পাওয়া,
কতই বা হারানো,
খেয়া ধরে ঘাটে আঘাটায়
নদী-পারানো।
এমনি করে দিন কেটেছে, হবে সে-দিন সারা
বেয়ে সর্বসাধারণের ধারা।
শুধাও যদি সবশেষে তার রইল কী ধন বাকী,
স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি তা কি!
জানি, এমন নাই কিছু যা পড়বে কারো চোখে,
স্মরণ-বিস্মরণের দোলায় দুলবে বিশ্বলোকে।
নয় সে মানিক, নয় সে সোনা,--
যায় না তারে যাচাই করা, যায় না তারে গোনা।
এই দেখো-না শীতের রোদের দিনের স্বপ্নে বোনা
সেগুন বনে সবুজ-মেশা সোনা,
শজনে গাছে লাগল ফুলের রেশ,
হিমঝুরির হৈমন্তী পালা হয়েছে নিঃশেষ।
বেগনি ছায়ার ছোঁওয়া-লাগা স্তব্ধ বটের শাখা
ঘোর রহস্যে ঢাকা।
ফলসা গাছের ঝরা পাতা গাছের তলা জুড়ে
হঠাৎ হাওয়ায় চমকে বেড়ায় উড়ে।
গোরুর গাড়ি মেঠো পথের তলে
উড়তি ধুলোয় দিকের আঁচল ধূসর ক'রে চলে।
নীরবতার বুকের মধ্যখানে
দূর অজানার বিধুর বাঁশি ভৈরবী সুর আনে।
কাজভোলা এই দিন
নীল আকাশে পাখির মতো নিঃসীমে হয় নীল।
এরি মধ্যে আছি আমি,
সব হতে এই দামি।
কেননা আজ বুকের কাছে যায় না জানা,
আরেকটি সেই দোসর আমি উড়িয়ে চলে বিরাট তাহার ডানা
জগতে জগতে
অন্তবিহীন ইতিহাসের পথে।
এই যে আমার কুয়োতলার কাছে
সামান্য ঐ আমের গাছে
কখনো বা রৌদ্র খেলায়, কভু শ্রাবণধারা,
সারা বয়ষ থাকে আপনহারা
সাধারণ এই অরণ্যানীর সবুজ আবরণে,
মাঘের শেষে অকারণে
ক্ষণকালের গোপন মন্ত্রবলে
গভীর মাটির তলে
শিকরে তার শিহর লাগে,
শাখায় শাখায় হঠাৎ বাণী জাগে,--
"আছি, আছি, এই যে আমি আছি।"
পুষ্পোচ্ছ্বাসে ধায় সে বাণী স্বর্গলোকের কাছাকাছি
দিকে দিগন্তরে।
চন্দ্র সূর্য তারার আলো তারে বরণ করে।
এমনি করেই মাঝে মাঝে সোনার কাঠি আনে
কভু প্রিয়ার মুগ্ধ চোখে, কভু কবির গানে--
অলস মনের শিয়রেতে কে সে অন্তর্যামী;
নিবিড় সত্যে জেগে ওঠে সামান্য এই আমি।
যে আমিরে ধূসর ছায়ায় প্রতিদিনের ভিড়ের মধ্যে দেখা
সেই আমিরে এক নিমেষের আলোয় দেখি একের মধ্যে একা।
সে-সব নিমেষ রয় কি না রয় কোনোখানে,
কেউ তাহাদের জানে বা না-ই জানে,
তবু তারা জীবনে মোর দেয় তো আনি
ক্ষণে ক্ষণে পরম বাণী
অনন্তকাল যাহা বাজে
বিশ্বচরাচরের মর্মমাঝে
"আছি আমি আছি"--
যে বাণীতে উঠে নাচি
মহাগগন-সভাঙ্গনে আলোক-অপ্সরী
তারার মাল্য পরি।






 #58

আমি চেয়ে আছি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবা-পানে।
স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।
নীচে সব-নীচে এ ধূলির ধরণীতে
যেথা আসনের মূল্য না হয় দিতে,
যেথা রেখা দিয়ে ভাগ করা নাই কিছু,
যেথা ভেদ নাই মানে আর অপমানে।
স্থান দাও সেথা সকলের মাঝখানে।

যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়,
যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়।
আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে
এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে,
সেথায় দাঁড়ায়ে নিলাজ দৈন্য মম
ভরিয়া লইব তাঁহার পরম দানে।
স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।



১৫ আষাঢ় ১৩১৭
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ১০৪






 #59

আমি বদল করেছি আমার বাসা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শ্রীমতী রানী দেবী কল্যাণীয়াসু


আমি বদল করেছি আমার বাসা।
দুটিমাত্র ছোটো ঘর আমার আশ্রয়।
ছোটো ঘরই আমার মনের মতো।
তার কারণ বলি তোমাকে।
বড়ো ঘর বড়োর ভান করে মাত্র,
আসল বড়োকে বাইরে ঠেকিয়ে রাখে অবজ্ঞায়।
আমার ছোটো ঘর বড়োর ভান করে না।
অসীমের প্রতিযোগিতার স্পর্ধা তার নেই
ধনী ঘরের মূঢ় ছেলের মতো।
আকাশের শখ ঘরে মেটাতে চাইনে;
তাকে পেতে চাই তার স্বস্থানে,
পেতে চাই বাইরে পূর্ণভাবে।
বেশ লাগছে।
দূর আমার কাছেই এসেছে।
জানলার পাশেই বসে বসে ভাবি--
দূর ব'লে যে পদার্থ সে সুন্দর।
মনে ভাবি সুন্দরের মধ্যেই দূর।
পরিচয়ের সীমার মধ্যে থেকেও
সুন্দর যায় সব সীমাকে এড়িয়ে।
প্রয়োজনের সঙ্গে লেগে থেকেও থাকে আলগা,
প্রতিদিনের মাঝখানে থেকেও সে চিরদিনের।
মনে পড়ে এক দিন মাঠ বেয়ে চলেছিলেম
পালকিতে অপরাহ্নে;
কাহার ছিল আটজন।
তার মধ্যে একজনকে দেখলেম
যেন কালো পাথরে কাটা দেবতার মূর্তি;
আপন কর্মের অপমানকে প্রতিপদে সে চলছিল পেরিয়ে
ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে পাখি যেমন যায় উড়ে।
দেবতা তার সৌন্দর্যে তাকে দিয়েছেন সুদূরতার সম্মান।
এই দূর আকাশ সকল মানুষেরই অন্তরতম;
জানলা বন্ধ, দেখতে পাইনে।
বিষয়ীর সংসার, আসক্তি তার প্রাচীর,
যাকে চায় তাকে রুদ্ধ করে কাছের বন্ধনে।
ভুলে যায় আসক্তি নষ্ট করে প্রেমকে,
আগাছা যেমন ফসলকে মারে চেপে।
আমি লিখি কবিতা, আঁকি ছবি।
দূরকে নিয়ে সেই আমার খেলা;
দূরকে সাজাই নানা সাজে,
আকাশের কবি যেমন দিগন্তকে সাজায়
সকালে সন্ধ্যায়।
কিছু কাজ করি তাতে লাভ নেই, তাতে লোভ নেই,
তাতে আমি নেই।
যে কাজে আছে দূরের ব্যাপ্তি
তাতে প্রতিমুহূর্তে আছে আমার মহাকাশ।
এই সঙ্গে দেখি মৃত্যুর মধুর রূপ, স্তব্ধ নিঃশব্দ সুদূর,
জীবনের চারদিকে নিস্তরঙ্গ মহাসমুদ্র;
সকল সুন্দরের মধ্যে আছে তার আসন, তার মুক্তি।


অন্য কথা পরে হবে।
গোড়াতেই বলে রাখি তুমি চা পাঠিয়েছ, পেয়েছি।
এতদিন খবর দিইনি সেটা আমার স্বভাবের বিশেষত্ব।
যেমন আমার ছবি আঁকা, চিঠি লেখাও তেমনি।
ঘটনার ডাকপিওনগিরি করে না সে।
নিজেরই সংবাদ সে নিজে।
জগতে রূপের আনাগোনা চলছে,
সেই সঙ্গে আমার ছবিও এক-একটি রূপ,
অজানা থেকে বেরিয়ে আসছে জানার দ্বারে।
সে প্রতিরূপ নয়।
মনের মধ্যে ভাঙাগড়া কত, কতই জোড়াতাড়া;
কিছু বা তার ঘনিয়ে ওঠে ভাবে,
কিছু বা তার ফুটে ওঠে চিত্রে;
এতদিন এই সব আকাশবিহারীদের ধরেছি কথার ফাঁদে।
মন তখন বাতাসে ছিল কান পেতে,
যে ভাব ধ্বনি খোঁজে তারি খোঁজে।
আজকাল আছে সে চোখ মেলে।
রেখার বিশ্বে খোলা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে, দেখবে ব'লে।
সে তাকায়, আর বলে, দেখলেম।
সংসারটা আকারের মহাযাত্রা।
কোন্‌ চির-জাগরূকের সামনে দিয়ে চলেছে,
তিনিও নীরবে বলছেন, দেখলেম।
আদি যুগে রঙ্গমঞ্চের সম্মুখে সংকেত এল,
"খোলো আবরণ।"
বাষ্পের যবনিকা গেল উঠে,
রূপের নটীরা এল বাহির হয়ে;
ইন্দ্রের সহস্র চক্ষু, তিনি দেখলেন।
তাঁর দেখা আর তাঁর সৃষ্টি একই।
চিত্রকর তিনি।
তাঁর দেখার মহোৎসব দেশে দেশে কালে কালে।


অসীম আকাশে কালের তরী চলেছে
রেখার যাত্রী নিয়ে,
অন্ধকারের ভূমিকায় তাদের কেবল
আকারের নৃত্য;
নির্বাক অসীমের বাণী
বাক্যহীন সীমার ভাষায়, অন্তহীন ইঙ্গিতে।--
অমিতার আনন্দসম্পদ
ডালিতে সাজিয়ে নিয়ে চলেছে সুমিতা,
সে ভাব নয়, সে চিন্তা নয়, বাক্য নয়,
শুধু রূপ, আলো দিয়ে গড়া।
আজ আদিসৃষ্টির প্রথম মুহূর্তের ধ্বনি
পৌঁছল আমার চিত্তে,--
যে ধ্বনি অনাদি রাত্রির যবনিকা সরিয়ে দিয়ে
বলেছিল, "দেখো।"
এতকাল নিভৃতে
আপনি যা বলেছি আপনি তাই শুনেছি,
সেখান থেকে এলেম আর-এক নিভৃতে,
এখানে আপনি যা আঁকছি, দেখছি তাই আপনি।
সমস্ত বিশ্ব জুড়ে দেবতার দেখবার আসন,
আমিও বসেছি তাঁরই পাদপীঠে,
রচনা করছি দেখা।






 #60

আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভ'রে।
না চাহিতে মোরে যা করেছ দান
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়
সে মহাদানেরই যোগ্য করে
অতি-ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।
আমি কখনো বা ভুলি, কখনো বা চলি
তোমার পথের লক্ষ্য ধরে-
তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে
যাও যে সরে।
এ যে তব দয়া জানি হায়,
নিতে চাও ব'লে ফিরাও আমায়,
পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন
তব মিলনেরই যোগ্য করে
আধা- ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।






 #61

আরবার ফিরে এল উৎসবের দিন 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আরবার ফিরে এল উৎসবের দিন।
বসন্তের অজস্র সম্মান
ভরি দিল তরুশাখা কবির প্রাঙ্গণে
নব জন্মদিনের ডালিতে।
রুদ্ধ কক্ষে দূরে আছি আমি--
এ বৎসরে বৃথা হল পলাশবনের নিমন্ত্রণ।
মনে করি,গান গাই বসন্তবাহারে।
আসন্ন বিরহস্বপ্ন ঘনাইয়া নেমে আসে মনে।
জানি জন্মদিন
এক অবিচিত্র দিনে ঠেকিবে এখনি,
মিলে যাবে অচিহ্নিত কালের পর্যায়ে।
পুষ্পবীথিকার ছায়া এ বিষাদে করে না করুণ,
বাজে না স্মৃতির ব্যথা অরণ্যের মর্মরে গুঞ্জনে
নির্মম আনন্দ এই উৎসবের বাজাইবে বাঁশি
বিচ্ছেদের বেদনারে পথপার্শ্বে ঠেলিয়া ফেলিয়া।






 #62

আরশি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তোমার যে ছায়া তুমি দিলে আরশিরে
হাসিমুখ মেজে,
সেইক্ষণে অবিকল সেই ছায়াটিরে
ফিরে দিল সে যে।
রাখিল না কিছু আর,
স্ফটিক সে নির্বিকার
আকাশের মতো--
সেথা আসে শশী রবি,
যায় চলে, তার ছবি
কোথা হয় গত।

একদিন শুধু মোরে ছায়া দিয়ে, শেষে
সমাপিলে খেলা
আত্মভোলা বসন্তের উন্মত্ত নিমেষে
শুক্ল সন্ধ্যাবেলা।
সে ছায়া খেলারই ছলে
নিয়েছিনু হিয়াতলে
হেলাভরে হেসে,
ভেবেছিনু চুপে চুপে
ফিরে দিব ছায়ারূপে
তোমারি উদ্দেশে।

সে ছায়া তো ফিরিল না, সে আমার প্রাণে
হল প্রাণবান।
দেখি, ধরা পড়ে গেল কবে মোর গানে
তোমার সে দান।
যদিবা দেখিতে তারে
পারিতে না চিনিবারে
অয়ি এলোকেশী--
আমার পরান পেয়ে
সে আজি তোমারো চেয়ে
বহুগুণে বেশি।

কেমনে জানিবে তুমি তারে সুর দিয়ে
দিয়েছি মহিমা।
প্রেমের অমৃতস্নানে সে যে, অয়ি প্রিয়ে,
হারায়েছে সীমা।
তোমার খেয়াল ত্যেজে
পূজার গৌরবে সে যে
পেয়েছে গৌরব।
মর্তের স্বপন ভুলে
অমরাবতীর ফুলে
লভিল সৌরভ।


৯ মাঘ, ১৩৩৮

#63

আশীর্বাদ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


পঞ্চাশ বছরের কিশোর গুণী নন্দলাল বসুর প্রতি
সত্তর বছরের প্রবীণ যুবা রবীন্দ্রনাথের আশীর্ভাষণ


নন্দনের কুঞ্জতলে রঞ্জনার ধারা,
জন্ম-আগে তাহার জলে তোমার স্নান সারা।
অঞ্জন সে কী মধুরাতে
লাগালো কে যে নয়নপাতে,
সৃষ্টি-করা দৃষ্টি তাই পেয়েছে আঁখিতারা।


এনেছে তব জন্মডালা অজর ফুলরাজি,
রূপের-লীলালিখন-ভরা পারিজাতের সাজি।
অপ্সরীর নৃত্যগুলি
তুলির মুখে এনেছ তুলি,
রেখার বাঁশি লেখার তব উঠিল সুরে বাজি।


যে মায়াবিনী আলিম্পনা সবুজে নীলে লালে
কখনো আঁকে কখনো মোছে অসীম দেশে কালে,
মলিন মেঘে সন্ধ্যাকাশে
রঙিন উপহাসি যে হাসে
রঙজাগানো সোনার কাঠি সেই ছোঁয়ালো ভালে।


বিশ্ব সদা তোমার কাছে ইশারা করে কত,
তুমিও তারে ইশারা দাও আপন মনোমত।
বিধির সাথে কেমন ছলে
নীরবে তব আলাপ চলে,
সৃষ্টি বুঝি এমনিতরো ইশারা অবিরত।


ছবির 'পরে পেয়েছ তুমি রবির বরাভয়,
ধূপছায়ার চপল মায়া করেছ তুমি জয়।
তব আঁকন-পটের 'পরে
জানি গো চিরদিনের তরে
নটরাজের জটার রেখা জড়িত হয়ে রয়।


চিরবালক ভুবনছবি আঁকিয়া খেলা করে,
তাহারি তুমি সমবয়সী মাটির খেলাঘরে।
তোমার সেই তরুণতাকে
বয়স দিয়ে কভু কি ঢাকে,
অসীম-পানে ভাসাও প্রাণ খেলার ভেলা-'পরে।


তোমারি খেলা খেলিতে আজি উঠেছে কবি মেতে,
নববালক জন্ম নেবে নূতন আলোকেতে।
ভাবনা তার ভাষায় ডোবা--
মুক্ত চোখে বিশ্বশোভা
দেখাও তারে, ছুটেছে মন তোমার পথে যেতে।






 #64

আষাঢ় 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।

ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন, ধবলীরে আনো গোহালে।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি
মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি,
রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।।

শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।
পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,
দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ,
দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি রে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।।

ওগো, আজ তোরা যাস নে গো, তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।
ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল,
ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল,
ওই বেণুবন দুলে ঘনঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।


- শিলাইদহ
২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৭






 #65

আহ্বান 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


জ্বেলে দিয়ে যাও সন্ধ্যাপ্রদীপ
বিজন ঘরের কোণে।
নামিল শ্রাবণ, কালো ছায়া তার
ঘনাইল বনে বনে।

বিস্ময় আনো ব্যগ্র হিয়ার পরশ-প্রতীক্ষায়
সজল পবনে নীল বসনের চঞ্চল কিনারায়,
দুয়ার-বাহির হতে আজি ক্ষণে ক্ষণে
তব কবরীর কবরীমালার বারতা আসুক মনে।

বাতায়ন হতে উৎসুক উই আঁখি
তব মঞ্জীর-ধ্বনি পথ বেয়ে
তোমারে কি যায় ডাকি।

কম্পিত এই মোর বক্ষের ব্যথা
অলকে তোমার আনে কি চঞ্চলতা
বকুলবনের মুখরিত সমীরণে।






 #66

আহ্বানসংগীত 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ওরে তুই জগৎ-ফুলের কীট,
জগৎ যে তোর শুকায়ে আসিল,
মাটিতে পড়িল খসে--
সারা দিন রাত গুমরি গুমরি
কেবলি আছিস বসে।
মড়কের কণা,নিজ হাতে তুই
রচিলি নিজের কারা,
আপনার জালে জড়ায়ে পড়িয়া
আপনি হইলি হারা।
অবশেষে কারে অভিশাপ দিস
হাহুতাশ করে সারা,
কোণে বসে শুধু ফেলিস নিশাস,
ঢালিস বিষের ধারা।

জগৎ যে তোর মুদিয়া আসিল,
ফুটিতে নারিল আর,
প্রভাত হইলে প্রাণের মাঝারে
ঝরে না শিশিরধার।
ফেলিস নিশাস, মরুর বাতাস
জ্বলিস জ্বালাস কত,
আপন জগতে আপনি আছিস
একটি রোগের মতো।
হৃদয়ের ভার বহিতে পার না,
আছ মাথা নত করে--
ফুটিবে না ফুল, ফলিবে না ফল,
শুকায়ে পড়িবে মরে।

রোদন,রোদন, কেবলি রোদন,
কেবলি বিষাদশ্বাস--
লুকায়ে, শুকায়ে, শরীর গুটায়ে
কেবলি কোটরে বাস।
নাই কোনো কাজ--মাঝে মাঝে চাস
মলিন আপনা-পানে,
আপনার স্নেহে কাতর বচন
কহিস আপন কানে।
দিবস রজনী মরীচিকাসুরা
কেবলি করিস পান।
বাড়িতেছে তৃষা, বিকারের তৃষা--
ছট্‌ফট্‌ করে প্রাণ।
‘দাও দাও’ ব’লে সকলি যে চাস,
জঠর জ্বলিছে ভুখে--
মুঠি মুঠি ধুলা তুলিয়া লইয়া
কেবলি পুরিস মুখে।
নিজের নিশাসে কুয়াশা ঘনায়ে
ঢেকেছে নিজের কায়া,
পথ আঁধারিয়া পড়েছে সমুখে
নিজের দেহের ছায়া।
ছায়ার মাঝারে দেখিতে না পাও,
শব্দ শুনিলে ডর’--
বাহু প্রসারিয়া চলিতে চলিতে,
নিজেরে আঁকড়ি ধর’।
চারি দিকে শুধু ক্ষুধা ছড়াইছে
যে দিকে পড়িছে দিঠ,
বিষেতে ভরিলি জগৎ রে তুই
কীটের অধম কীট।

আজিকে বারেক ভ্রমরের মতো
বাহির হইয়া আয়,
এমন প্রভাতে এমন কুসুম
কেন রে শুকায়ে যায়।
বাহিরে আসিয়া উপরে বসিয়া
কেবলি গাহিবি গান,
তবে সে কুসুম কহিবে রে কথা,
তবে সে খুলিবে প্রাণ।
আকাশে হাসিবে তরুণ তপন,
কাননে ছুটিবে বায়,
চারি দিকে তোর প্রাণের লহরী
উথলি উথলি যায়।
বায়ুর হিল্লোলে ধরিবে পল্লব
মরমর মৃদু তান,
চারি দিক হতে কিসের উল্লাসে
পাখিতে গাহিবে গান।
নদীতে উঠিবে শত শত ঢেউ,
গাবে তারা কল কল,
আকাশে আকাশে উথলিবে শুধু
হরষের কোলাহল।
কোথাও বা হাসি কোথাও বা খেলা
কোথাও বা সুখগান--
মাঝে বসে তুই বিভোর হইয়া,
আকুল পরানে নয়ান মুদিয়া
অচেতন সুখে চেতনা হারায়ে
করিবি রে মধুপান।
ভুলে যাবি ওরে আপনারে তুই
ভুলে যাবি তোর গান।
মোহ ছুটিবে রে নয়নেতে তোর,
যে দিকে চাহিবি হয়ে যাবে ভোর,
যাহারে হেরিবি তাহারে হেরিয়া
মজিয়া রহিবে প্রাণ।
ঘুমের ঘোরেতে গাহিবে পাখি
এখনো যে পাখি জাগে নি,
ভোরের আকাশ ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া
উঠিবে বিভাসরাগিণী।
জগৎ-অতীত আকাশ হইতে
বাজিয়া উঠিবে বাঁশি,
প্রাণের বাসনা আকুল হইয়া
কোথায় যাইবে ভাসি।
উদাসিনী আশা গৃহ তেয়াগিয়া
অসীম পথের পথিক হইয়া
সুদূর হইতে সুদূরে উঠিয়া
আকুল হইয়া চায়,
যেমন বিভোর চকোরের গান
ভেদিয়া ভেদিয়া সুদূর বিমান
চাঁদের মরণে মরিতে গিয়া
মেঘেতে হারায়ে যায়।
মুদিত নয়ান, পরান বিভল,
স্তব্ধ হইয়া শুনিবি কেবল,
জগতেরে সদা ডুবায়ে দিতেছে
জগৎ-অতীত গান--
তাই শুনি যেন জাগিতে চাহিছে
ঘুমেতে-মগন প্রাণ।
জগৎ বাহিরে যমুনাপুলিনে
কে যেন বাজায় বাঁশি,
স্বপন-সমান পশিতেছে কানে
ভেদিয়া নিশীথরাশি--

এ গান শুনি নি,এ আলো দেখি নি,
এ মধু করিনি পান,
এমন বাতাস পরান পুরিয়া
করে নি রে সুধা দান,
এমন প্রভাত-কিরণ মাঝার
কখনো করি নি স্নান,
বিফলে জগতে লভিনু জনম,
বিফলে কাটিল প্রাণ।
দেখ্‌ রে সবাই চলেছে বাহিরে
সবাই চলিয়া যায়,
পথিকেরা সবে হাতে হাতে ধরি
শোন্‌ রে কী গান গায়।
জগৎ ব্যাপিয়া শোন্‌ রে সবাই
ডাকিতেছে, আয়,আয়--
কেহ বা আগেতে কেহ বা পিছায়ে,
কেহ ডাক শুনে ধায়।

অসীম আকাশে স্বাধীন পরানে
প্রাণের আবেগে ছোটে,
এ শোভা দেখিলে জড়ের শরীরে
পরান নাচিয়া ওঠে।
তুই শুধু ওরে ভিতরে বসিয়া
গুমরি মরিতে চাস!
তুই শুধু ওরে করিস রোদন,
ফেলিস দুখের শ্বাস!
ভূমিতে পড়িয়া আঁধারে বসিয়া
আপনা লইয়া রত
আপনারে সদা কোলেতে তুলিয়া
সোহাগ করিস কত!
আর কতদিন কাটিবে এমন,
সময় যে চলে যায়।
ওই শোন্‌ ওই ডাকিছে সবাই,
বাহির হইয়া আয়!






 #67

ইস্টেশন 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


সকাল বিকাল ইস্টেশনে আসি,
চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালবাসি।
ব্যস্ত হয়ে ওরা টিকিট কেনে,
ভাঁটির ট্রেনে কেউ-বা চড়ে
কেউ-বা উজান ট্রেনে।
সকাল থেকে কেউ-বা থাকে বসে,
কেউ-বা গাড়ি ফেল্‌ করে তার
শেষ-মিনিটের দোষে।
দিনরাত গড়্‌গড়্‌ ঘড়্‌ঘড়্‌,
গাড়িভরা মানুষের ছোটে ঝড়।
ঘন ঘন গতি তার ঘুরবে
কভু পশ্চিমে, কভু পূর্বে।
চলচ্ছবির এই-যে মূর্তিখানি
মনেতে দেয় আনি
নিত্য-মেলার নিত্য-ভোলার ভাষা--
কেবল যাওয়া-আসা।
মঞ্চতলে দণ্ডে পলে
ভিড় জমা হয় কত--
পতাকাটা দেয় দুলিয়ে,
কে কোথা হয় গত।
এর পিছনে সুখদুঃখ-
ক্ষতিলাভের তাড়া
দেয় সবলে নাড়া।
সময়ের ঘড়িধরা অঙ্কেতে
ভোঁ ভোঁ ক'রে বাঁশি বাজে সংকেতে।
দেরি নাহি সয় কারো কিছুতেই
কেহ যায়, কেহ থাকে পিছুতেই।
ওদের চলা ওদের পড়ে-থাকায়
আর কিছু নেই, ছবির পরে
কেবল ছবি আঁকায়।
খানিকক্ষণ যা চোখে পড়ে
তার পরে যায় মুছে,
আত্ম-অবহেলার খেলা
নিত্যই যায় ঘুচে।
ছেঁড়া পটের টুকরো জমে
পথের প্রান্ত জুড়ে,
তপ্ত দিনের ক্লান্ত হাওয়ায়
কোন্‌খানে যায় উড়ে।
"গেল গেল' ব'লে যারা
ফুকরে কেঁদে ওঠে
ক্ষণেক-পরে কান্না-সমেত
তারাই পিছে ছোটে।
ঢং ঢং বেজে ওঠে ঘণ্টা,
এসে পড়ে বিদায়ের ক্ষণটা।
মুখ রাখে জানলায় বাড়িয়ে,
নিমেষেই নিয়ে যায় ছাড়িয়ে।
চিত্রকরের বিশ্বভুবনখানি--
এই কথাটাইনিলেম মনে মানি।
কর্মকারের নয় এ গড়া-পেটা--
আঁকড়ে ধরার জিনিস এ নয়,
দেখার জিনিস এটা।
কালের পরে যায় চলে কাল,
হয় না কভু হারা
ছবির বাহন চলাফেরার ধারা।
দুবেলা সেই এ সংসারের
চলতি ছবি দেখা,
এই নিয়ে রই যাওয়া-আসাআর
ইস্টেশনে একা।

এক তুলি ছবিখানা এঁকে দেয়,
আর তুলি কালি তাহে মেখে দেয়।
আসে কারা এক দিক হতে ঐ,
ভাসে কারা বিপরীত স্রোতে ঐ।






 #68

উদবৃত্ত 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তব দক্ষিণ হাতের পরশ
কর নি সমর্পন।
লেকে আর মেছে তব আলো ছায়া
ভাবনার প্রাঙ্গণে
খনে খনে আলিপন।

বৈশাখে কৃশ নদী
পূর্ণ স্রোতের প্রসাদ না দিল যদি
শুধু কুণ্ঠিত বিশীর্ণ ধারা
তীরের প্রান্তে
জাগালো পিয়াসী মন।

যতটুকু পাই ভীরু বাসনার
অঞ্জলিতে
নাই বা উচ্ছলিল,
সারা দিবসের দৈন্যের শেসে
সঞ্চয় সে যে
সারা জীবনের স্বপ্নের আয়োজন।






 #69

উদ্বোধন 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে
প্রথম দিনের উষা নেমে এল যবে
প্রকাশপিয়াসি ধরিত্রী বনে বনে
শুধায়ে ফিরিল, সুর খুঁজে পাবে কবে।
এসো এসো সেই নব সৃষ্টির কবি
নবজাগরণ-যুগপ্রভাতের রবি।
গান এনেছিলে নব ছন্দের তালে
তরুণী উষার শিশিরস্নানের কালে,
আলো-আঁধারের আনন্দবিপ্লবে।
সে গান আজিও নানা রাগরাগিণীতে
শুনাও তাহারে আগমনীসংগীতে
যে জাগায় চোখে নূতন দেখার দেখা।
যে এসে দাঁড়ায় ব্যাকুলিত ধরণীতে
বননীলিমার পেলব সীমানাটিতে,
বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা।
অবাক আলোর লিপি যে বহিয়া আনে
নিভৃত প্রহরে কবির চকিত প্রাণে,
নব পরিচয়ে বিরহব্যথা যে হানে
বিহ্বল প্রাতে সংগীতসৌরভে,
দূর-আকাশের অরুণিম উৎসবে।
যে জাগায় জাগে পূজার শঙ্খধ্বনি,
বনের ছায়ায় লাগায় পরশমণি,
যে জাগায় মোছে ধরার মনের কালি
মুক্ত করে সে পূর্ণ মাধুরী-ডালি।
জাগে সুন্দর, জাগে নির্মল, জাগে আনন্দময়ী--
জাগে জড়ত্বজয়ী।
জাগো সকলের সাথে
আজি এ সুপ্রভাতে,
বিশ্বজনের প্রাঙ্গণতলে লহো আপনার স্থান--
তোমার জীবনে সার্থক হোক
নিখিলের আহ্বান।






 #70

ঋষি কবি বলেছেন 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


পরি দ্যাবা পৃথিবী সদ্য আয়ম্‌
উপাতিষ্ঠে প্রথমজামৃতস্য।
--অথর্ববেদ


ঋষি কবি বলেছেন--
ঘুরলেন তিনি আকাশ পৃথিবী,
শেষকালে এসে দাঁড়ালেন
প্রথমজাত অমৃতের সম্মুখে।
কে এই প্রথমজাত অমৃত,
কী নাম দেব তাকে?
তাকেই বলি নবীন,
সে নিত্যকালের।
কত জরা কত মৃত্যু
বারে বারে ঘিরল তাকে চারদিকে,
সেই কুয়াশার মধ্যে থেকে
বারে বারে সে বেরিয়ে এল,
প্রতিদিন ভোরবেলার আলোতে
ধ্বনিত হল তার বাণী--
"এই আমি প্রথমজাত অমৃত।"
দিন এগোতে থাকে,
তপ্ত হয়ে ওঠে বাতাস,
আকাশ আবিল হয়ে ওঠে ধুলোয়,
বৃদ্ধ সংসারের কর্কশ কোলাহল
আবর্তিত হতে থাকে
দূর হতে দূরে।
কখন দিন আসে আপন শেষপ্রান্তে,
থেমে যায় তাপ,
নেমে যায় ধুলো,
শান্ত হয় কর্কশ কণ্ঠের পরিণামহীন বচসা,
আলোর যবনিকা সরে যায়
দিক্‌সীমার অন্তরালে।
অন্তহীন নক্ষত্রলোকে,
ম্লানিহীন অন্ধকারে
জেগে ওঠে বাণী--
"এই আমি প্রথমজাত অমৃত।"
শতাব্দীর পর শতাব্দী
আপনাকে ঘোষণা করে
মানুষের তপস্যায়;
সে-তপস্যা
ক্লান্ত হয়,
হোমাগ্নি যায় নিবে,
মন্ত্র হয় অর্থহীন,
জীর্ণ সাধনার শতছিদ্র মলিন আচ্ছাদন
ম্রিয়মাণ শতাব্দীকে ফেলে ঢেকে।
অবশেষে কখন
শেষ সূর্যাস্তের তোরণদ্বারে
নিঃশব্দচরণে আসে
যুগান্তের রাত্রি,
অন্ধকারে জপ করে শান্তিমন্ত্র
শবাসনে সাধকের মতো।
বহুবর্ষব্যাপী প্রহর যায় চলে,
নবযুগের প্রভাত
শুভ্র শঙ্খ হাতে
দাঁড়ায় উদয়াচলের স্বর্ণশিখরে,
দেখা যায়,
তিমিরধারায় ক্ষালন করেছে কে
ধূলিশায়ী শতাব্দীর আবর্জনা;
ব্যাপ্ত হয়েছে অপরিসীম ক্ষমা
অন্তর্হিত অপরাধের
কলঙ্কচিহ্নের 'পরে।
পেতেছে শান্ত জ্যোতির আসন
প্রথমজাত অমৃত।
বালক ছিলেম,
নবীনকে তখন দেখেছি আনন্দিত চোখে
ধরণীর সবুজে,
আকাশের নীলিমায়।
দিন এগোল।
চলল জীবনযাত্রার রথ
এ-পথে ও-পথে।
ক্ষুব্ধ অন্তরের তাপতপ্ত নিঃশ্বাস।
শুকনো পাতা ওড়াল দিগন্তে।
চাকার বেগে
বাতাস ধুলায় হল নিবিড়।
আকাশচর কল্পনা
উড়ে গেল মেঘের পথে,
ক্ষুধাতুর কামনা
মহ্যাহ্নের রৌদ্রে
ঘুরে বেড়াল ধরাতলে
ফলের বাগানে ফসলের খেতে
আহূত অনাহূত।
আকাশে পৃথিবীতে
এ জন্মের ভ্রমণ হল সারা
পথে বিপথে।
আজ এসে দাঁড়ালেম
প্রথমজাত অমৃতের সম্মুখে।






 #71

একদিন তুচ্ছ আলাপের ফাঁক দিয়ে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


একদিন তুচ্ছ আলাপের ফাঁক দিয়ে
কোন্‌ অভাবনীয় স্মিতহাস্যে
আমার আত্মবিহ্বল যৌবনটাকে
দিলে তুমি দোলা;
হঠাৎ চমক দিয়ে গেল তোমার মুখে
একটি অমৃতরেখা;
আর কোনোদিন তার দেখা মেলেনি।
জোয়ারের তরঙ্গলীলায় গভীর থেকে উৎক্ষিপ্ত হল
চিরদুর্লভের একটি রত্নকণা
শতলক্ষ ঘটনার সমুদ্র-বেলায়।
এমনি এক পলকে বুকে এসে লাগে
অপরিচিত মুহূর্তের চকিত বেদনা
প্রাণের আধখোলা জালনায়
দূর বনান্ত থেকে
পথ-চলতি গানে।
অভূতপূর্বের অদৃশ্য অঙ্গুলি বিরহের মীড় লাগিয়ে যায়
হৃদয়-তারে
বৃষ্টিধারামুখর নির্জন প্রবাসে,
সন্ধ্যাযূথীর করুণ স্নিগ্ধ গন্ধে,
রেখে দিয়ে যায় কোন্‌ অলক্ষ্যে আকস্মিক
আপন স্খলিত উত্তরীয়ের স্পর্শ।
তার পরে মনে পড়ে
একদিন সেই বিস্ময়-উন্মনা নিমেষটিকে
অকারণে অসময়ে;
মনে পড়ে শীতের মধ্যাহ্নে,
যখন গোরুচরা শস্যরিক্ত মাঠের দিকে
চেয়ে চেয়ে বেলা যায় কেটে;
মনে পড়ে, যখন সঙ্গহারা সায়াহ্নের অন্ধকারে
সূর্যাস্তের ওপার থেকে বেজে ওঠে
ধ্বনিহীন বীণার বেদনা।


 #72

একাকিনী 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


একাকিনী বসে থাকে আপনারে সাজায়ে যতনে।
বসনে ভূষণে
যৌবনেরে করে মূল্যবান।
নিজেরে করিবে দান
যার হাতে
সে অজানা তরুণের সাথে
এই যেন দূর হতে তার কথা-বলা।
এই প্রসাধনকলা,
নয়নের এ-কজ্জললেখা,
উজ্জ্বল বসন্তীরঙা অঞ্চলের এ-বঙ্কিমরেখা
মণ্ডিত করেছে দেহ প্রিয়সম্ভাষণে।
দক্ষিণপবনে
অস্পষ্ট উত্তর আসে শিরীষের কম্পিত ছায়ায়।
এইমতো দিন যায়,
ফাগুনের গন্ধে ভরা দিন।
সায়াহ্নিক দিগন্তের সীমন্তে বিলীন
কুঙ্কুম-আভায় আনে
উৎকণ্ঠিত প্রাণে
তুলি' দীর্ঘশ্বাস--
অভাবিত মিলনের আরক্ত আভাস।






 #73

এপারে-ওপারে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


রাস্তার ওপারে
বাড়িগুলি ঘেঁষাঘেঁষি সারে সারে।
ওখানে সবাই আছে
ক্ষীণ যত আড়ালের আড়ে-আড়ে কাছে-কাছে।
যা-খুশী প্রসঙ্গ নিয়ে
ইনিয়ে-বিনিয়ে
নানা কণ্ঠে বকে যায় কলস্বরে।
অকারণে হাত ধরে;
যে যাহারে চেনে
পিঠেতে চাপড় দিয়ে নিয়ে যায় টেনে
লক্ষ্যহীন অলিতে গলিতে,
কথা-কাটাকাটি চলে গলাগলি চলিতে চলিতে।
বৃথাই কুশলবার্তা জানিবার ছলে
প্রশ্ন করে বিনা কৌতূহলে।
পরস্পরে দেখা হয়,
বাঁধা ঠাট্টা করে বিনিময়।
কোথা হতে অকস্মাৎ ঘরে ঢুকে
হেসে ওঠে অহেতু কৌতুকে।
"আনন্দবাজার' হতে সংবাদ-উচ্ছিষ্ট ঘেঁটে ঘেঁটে
ছুটির মধ্যাহ্নবেলা বিষম বিতর্কে যায় কেটে।
সিনেমা-নটীর ছবি নিয়ে দুই দলে
রূপের তুলনা-দ্বন্দ্ব চলে,
উত্তাপ প্রবল হয় শেষে
বন্ধুবিচ্ছেদের কাছে এসে।
পথপ্রান্তে দ্বারের সম্মুখে বসি
ফেরিওয়ালাদের সাথে হুঁকো-হাতে দর-কষাকষি।
একই সুরে দম দিয়ে বার বার
গ্রামোফোনে চেষ্টা চলে থিয়েটরি গান শিখিবার।
কোথাও কুকুরছানা ঘেউ-ঘেউ আদরের ডাকে
চমক লাগায় বাড়িটাকে।
শিশু কাঁদে মেঝে মাথা হানি,
সাথে চলে গৃহিণীর অসহিষ্ণু তীব্র ধমকানি।
তাস-পিটোনির শব্দ, নিয়ে জিত হার
থেকে থেকে বিষম চিৎকার।
যেদিন ট্যাক্সিতে চ'ড়ে জামাই উদয় হয় আসি
মেয়েতে মেয়েতে হাসাহাসি,
টেপাটেপি, কানাকানি,
অঙ্গরাগে লাজুকেরে সাজিয়ে দেবার টানাটানি।
দেউরিতে ছাতে বারান্দায়
নানাবিধ আনাগোনা ক্ষণে ক্ষণে ছায়া ফেলে যায়।
হেথা দ্বার বন্ধ হয় হোথা দ্বার খোলে,
দড়িতে গামছা ধুতি ফর্‌ফর্‌ শব্দ করি ঝোলে।
অনির্দিষ্ট ধ্বনি চারি পাশে
দিনে রাত্রে কাজের আভাসে।
উঠোনে অনবধানে-খুলে-রাখা কলে
জল বহে যায় কলকলে;
সিঁড়িতে আসিতে যেতে
রাত্রিদিন পথ স্যাঁত্‌সেঁতে।
বেলা হলে ওঠে ঝন্‌ঝনি
বাসন-মাজার ধ্বনি।
বেড়ি হাতা খুন্তি রান্নাঘরে
ঘরকরনার সুরে ঝংকার জাগায় পরস্পরে।
কড়ায় সর্ষের তেল চিড়্‌বিড়্‌ ফোটে,
তারি মধ্যে কইমাছ অকস্মাৎ ছ্যাঁক্‌ করে ওঠে।
বন্দেমাতরম্‌-পেড়ে শাড়ি নিয়ে তাঁতিবউ ডাকে
বউমাকে।
খেলার ট্রাইসিকেলে
ছড়্‌ ছড়্‌ খড়্‌ খড়্‌ আঙিনায় ঘোরে কার ছেলে।
যাদের উদয় অস্ত আপিসের দিক্‌চক্রবালে
তাদের গৃহিণীদের সকালে বিকালে
দিন পরে দিন যায়
দুইবার জোয়ার-ভাঁটায়
ছুটি আর কাজে।
হোথা পড়া-মুখস্থের একঘেয়ে অশ্রান্ত আওয়াজে
ধৈর্য হারাইছে পাড়া,
এগ্‌জামিনেশনে দেয় তাড়া।
প্রাণের প্রবাহে ভেসে
বিবিধ ভঙ্গীতে ওরা মেশে।
চেনা ও অচেনা
লঘু আলাপের ফেনা
আবর্তিয়া তোলে
দেখাশোনা আনাগোনা গতির হিল্লোলে।
রাস্তার এপারে আমি নিঃশব্দ দুপুরে
জীবনের তথ্য যত ফেলে রেখে দূরে
জীবনের তত্ত্ব যত খুঁজি
নিঃসঙ্গ মনের সঙ্গে যুঝি,
সারাদিন চলেছে সন্ধান
দুরূহের ব্যর্থ সমাধান।
মনের ধূসর কূলে
প্রাণের জোয়ার মোরে একদিন দিয়ে গেছে তুলে।
চারি দিকে তীক্ষ্ণ আলো ঝক্‌ঝক্‌ করে
রিক্তরস উদ্দীপ্ত প্রহরে।
ভাবি এই কথা--
ওইখানে ঘনীভূত জনতার বিচিত্র তুচ্ছতা
এলোমেলো আঘাতে সংঘাতে
নানা শব্দ নানা রূপ জাগিয়ে তুলিছে দিনরাতে।
কিছু তার টেঁকে নাকো দীর্ঘকাল,
মাটিগড়া মৃদঙ্গের তাল
ছন্দটারে তার
বদল করিছে বারংবার।
তারি ধাক্কা পেয়ে মন
ক্ষণে-ক্ষণ
ব্যগ্র হয়ে ওঠে জাগি
সর্বব্যাপী সামান্যের সচল স্পর্শের লাগি।
আপনার উচ্চতট হতে
নামিতে পারে না সে যে সমস্তের ঘোলা গঙ্গাস্রোতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা




 #74

ওরা এসে আমাকে বলে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ওরা এসে আমাকে বলে,
কবি, মৃত্যুর কথা শুনতে চাই তোমার মুখে।
আমি বলি,
মৃত্যু যে আমার অন্তরঙ্গ,
জড়িয়ে আছে আমার দেহের সকল তন্তু।
তার ছন্দ আমার হৃৎস্পন্দনে,
আমার রক্তে তার আনন্দের প্রবাহ।
বলছে সে,--চলো চলো,
চলো বোঝা ফেলতে ফেলতে,
চলো মরতে মরতে নিমেষে নিমেষে
আমারি টানে, আমারি বেগে।
বলছে, চুপ করে বস যদি
যা-কিছু আছে সমস্তকে আঁকড়িয়ে ধরে
তবে দেখবে, তোমার জগতে
ফুল গেল বাসি হয়ে,
পাঁক দেখা দিল শুকনো নদীতে,
ম্লান হল তোমার তারার আলো।
বলছে, "থেমো না, থেমো না,
পিছনে ফিরে তাকিয়ো না,
পেরিয়ে যাও পুরোনোকে জীর্ণকে ক্লান্তকে অচলকে।
"আমি মৃত্যু-রাখাল
সৃষ্টিকে চরিয়ে চরিয়ে নিয়ে চলেছি
যুগ হতে যুগান্তরে
নব নব চারণ-ক্ষেত্রে।
"যখন বইল জীবনের ধারা
আমি এসেছি তার পিছনে পিছনে,
দিইনি তাকে কোনো গর্তে আটক থাকতে।
তীরের বাঁধন কাটিয়ে কাটিয়ে
ডাক দিয়ে নিয়ে গেছি মহাসমুদ্রে,
সে সমুদ্র আমিই।
"বর্তমান চায় বর্তিয়ে থাকতে।
সে চাপাতে চায়
তার সব বোঝা তোমার মাথায়,
বর্তমান গিলে ফেলতে চায়
তোমার সব-কিছু আপন জঠরে।
তার পরে অবিচল থাকতে চায়
আকণ্ঠপূর্ণ দানবের মতো
জাগরণহীন নিদ্রায়।
তাকেই বলে প্রলয়।
এই অনন্ত অচঞ্চল বর্তমানের হাত থেকে
আমি সৃষ্টিকে পরিত্রাণ করতে এসেছি,
অন্তহীন নব নব অনাগতে।"






 #75

ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে
পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।
আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়;
আর তো কিছুই নড়ে না রে
ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়।
ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা,
চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,
ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা
অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়।
আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ,
দেখে না যে বাণ ডেকেছে
জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।
চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে
মাটির ‘পরে চরণ ফেলে ফেলে,
আছে অচল আসনখানা মেলে
যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায়,
আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।
হঠাৎ আলো দেখবে যখন
ভাববে এ কী বিষম কাণ্ডখানা।
সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে,
শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে,
সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে
লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়।
আয় প্রচণ্ড, আয় রে আমার কাঁচা।

শিকল-দেবীর ওই যে পূজাবেদী
চিরকাল কি রইবে খাড়া।
পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি।
ঝড়ের মাতন, বিজয়-কেতন নেড়ে
অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে,
ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে
ভুলগুলো সব আন্‌ রে বাছা-বাছা।
আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

আন্‌ রে টেনে বাঁধা-পথের শেষে।
বিবাগী কর্‌ অবাধপানে,
পথ কেটে যাই অজানাদের দেশে।
আপদ আছে, জানি অঘাত আছে,
তাই জেনে তো বক্ষে পরান নাচে,
ঘুচিয়ে দে ভাই পুঁথি-পোড়োর কাছে
পথে চলার বিধিবিধান যাচা।
আয় প্রমুক্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,
জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে
প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।
সবুজ নেশায় ভোর করেছি ধরা,
ঝড়ের মেঘে তোরি তড়িৎ ভরা,
বসন্তেরে পরাস আকুল-করা
আপন গলার বকুল-মাল্যগাছা,
আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা।






 #76

কণিকা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


যথার্থ আপন

কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান,
বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান।
ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,
চন্দ্রসূর্যতারকারে করে 'ভাই ভাই'।
নভশ্চর ব'লে তাঁর মনের বিশ্বাস,
শূন্য-পানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস।
ভাবে, 'শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে
বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতাডোরে;
বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে
উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।'
বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি---
সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।


হাতে-কলমে

বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক,
এরই তরে মধুকর এত করে জাঁক!
মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই,
আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই॥


গৃহভেদ

আম্র কহে, একদিন, হে মাকাল ভাই,
আছিনু বনের মাঝে সমান সবাই;
মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি---
মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি॥


গরজের আত্মীয়তা

কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে,
আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে?
থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে
আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে॥


কুটুম্বিতা

কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই ব'লে ডাকো যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা;
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা॥


উদারচরিতানাম্

প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন
ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন।
ধিক্-ধিক্ করে তারে কাননে সবাই;
সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছি ভাই?।


অসম্ভব ভালো

যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো,
কোন্ স্বর্গপুরী তুমি করে থাকো আলো?
আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়
অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়॥


প্রত্যক্ষ প্রমাণ

বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ
আমর গর্জনে বলে মেঘের গর্জন,
বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে,
মাথায় পড়িলে তবে বলে--- 'বজ্র বটে!'


ভক্তিভাজন

রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম---
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব'--- হাসে অন্তর্যামী॥


উপকারদম্ভ

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,
লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির॥


সন্দেহের কারণ

'কত বড়ো আমি' কহে নকল হীরাটি।
তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি॥


অকৃতজ্ঞ

ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে,
ধ্বনি-কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে॥


নিজের ও সাধারণের

চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে,
কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে॥


মাঝারির সতর্কতা

উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে॥


নতিস্বীকার

তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়,
তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়,
অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে
প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে॥


কর্তব্যগ্রহণ

কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি---
শুনিয়া জগত্‍‌ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি॥


ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তি

রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা॥


মোহ

নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ও পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ও পার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে---
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলই ও পারে॥


ফুল ও ফল

ফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল,
কত দূরে রয়েছিস বল্ মোরে বল্!
ফল কহে মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি---
তোমারই অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি॥


প্রশ্নের অতীত

হে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা?
সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা।
কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর?
হিমাদ্রি কহিল, মোর চিরনিরুত্তর॥


মোহের আশঙ্কা

শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা---
শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধ-ভরা;
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো॥


চালক

অদৃষ্টেরে শুধালেম, চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলেম থামি,
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি॥



সূত্রঃ কণিকা / সঞ্চয়িতা






 #77

কত অজানারে জানাইলে তুমি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কত অজানারে জানাইলে তুমি,
কত ঘরে দিলে ঠাঁই-
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।
পুরনো আবাস ছেড়ে যাই যবে
মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে,
নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন
সে কথা যে ভুলে যাই।
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।

জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে
যখনি যেখানে লবে,
চির জনমের পরিচিত ওহে,
তুমিই চিনাবে সবে।
তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর,
নাহি কোন মানা, নাহি কোন ডর,
সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ-
দেখা যেন সদা পাই।
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।






 #78
কত কী যে আসে কত কী যে যায 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কত কী যে আসে কত কী যে যায়
বাহিয়া চেতনাবাহিনী!
আঁধারে আড়ালে গোপনে নিয়ত
হেথা হোথা তারি পড়ে থাকে কত---
ছিন্নসূত্র বাছি শত শত
তুমি গাঁথ বসে কাহিনী।
ওগো একমনা, ওগো অগোচরা,
ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী!

তব ঘরে কিছু ফেলা নাহি যায়
ওগো হৃদয়ের গেহিনী!
কত সুখ দুখ আসে প্রতিদিন,
কত ভুলি কত হয়ে আসে ক্ষীণ---
তুমি তাই লয়ে বিরামবিহীন
রচিছ জীবনকাহিনী।
আঁধারে বসিয়া কী যে কর কাজ
ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী।

কত যুগ ধরে এমনি গাঁথিছ
হৃদিশতদলশায়িনী!
গভীর নিভৃতে মোর মাঝখানে
কী যে আছে কী যে নাই কে বা জানে,
কী জানি রচিলে আমার পরানে
কত-না যুগের কাহিনী---
কত জনমের কত বিস্মৃতি
ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী।






 #79

কন্যাবিদায় 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


জননী, কন্যারে আজ বিদায়ের ক্ষণে
আপন অতীতরূপ পড়িয়াছে মনে
যখন বালিকা ছিলে।
মাতৃক্রোড় হতে
তোমারে ভাসালো ভাগ্য দূরতর স্রোতে
সংসারের।
তার পর গেল কত দিন
দুঃখে সুখে,
বিচ্ছেদের ক্ষত হল ক্ষীণ।


এ-জন্মের আরম্ভভূমিকা-- সংকীর্ণ সে
প্রথম উষার মতো-- ক্ষণিক প্রদোষে
মিলাইল লয়ে তার স্বর্ণ কুহেলিকা।
বাল্যে পরেছিলে শুভ্র মাঙ্গল্যের টিকা,
সিন্দূররেখায় হল লীন।
সে-রেখাটি
জীবনের পূর্বভাগ দিল যেন কাটি।
আজ সেই ছিন্নখণ্ড ফিরে এল শেষে
তোমার কন্যার মাঝে অশ্রুর আবেশে।






 #80

করিয়াছি বাণীর সাধনা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


করিয়াছি বাণীর সাধনা
দীর্ঘকাল ধরি,
আজ তারে ক্ষণে ক্ষণে উপহাস পরিহাস করি।
বহু ব্যবহার আর দীর্ঘ পরিচয়
তেজ তার করিতেছে ক্ষয়।
নিজেরে করিয়া অবহেলা
নিজেরে নিয়ে সে করে খেলা।
তবু জানি, অজানার পরিচয় আছিল নিহিত
বাক্যে তার বাক্যের অতীত।
সেই অজানার দূত আজি মোরে নিয়ে যায় দূরে,
অকূল সিন্ধুরে
নিবেদন করিতে প্রণাম,
মন তাই বলিতেছে, আমি চলিলাম।


সেই সিন্ধু-মাঝে সূর্য দিনযাত্রা করি দেয় সারা,
সেথা হতে সন্ধ্যাতারা
রাত্রিরে দেখায়ে আনে পথ
যেথা তার রথ
চলেছে সন্ধান করিবারে
নূতন প্রভাত-আলো তমিস্রার পারে।
আজ সব কথা,
মনে হয়, শুধু মুখরতা।
তারা এসে থামিয়াছে
পুরাতন সে মন্ত্রের কাছে
ধ্বনিতেছে যাহা সেই নৈঃশব্দ্যচূড়ায়
সকল সংশয় তর্ক যে মৌনের গভীরে ফুরায়।
লোকখ্যাতি যাহার বাতাসে
ক্ষীণ হয়ে তুচ্ছ হয়ে আসে।
দিনশেষে কর্মশালা ভাষা রচনার
নিরুদ্ধ করিয়া দিক দ্বার।
পড়ে থাক্‌ পিছে
বহু আবর্জনা, বহু মিছে।
বারবার মনে মনে বলিতেছি, আমি চলিলাম--
যেথা নাই নাম,
যেখানে পেয়েছে লয়
সকল বিশেষ পরিচয়,
নাই আর আছে
এক হয়ে যেথা মিশিয়াছে,
যেখানে অখন্ড দিন
আলোহীন অন্ধকারহীন,
আমার আমির ধারা মিলে যেথা যাবে ক্রমে ক্রমে
পরিপূর্ণ চৈতন্যের সাগরসংগমে।
এই বাহ্য আবরণ, জানি না তো, শেষে
নানা রূপে রূপান্তরে কালস্রোতে বেড়াবে কি ভেসে।
আপন স্বাতন্ত্র৻হতেনিঃসক্তদেখিবতারেআমি
বাহিরে বহুর সাথে জড়িত অজানা তীর্থগামী।


আসন্ন বর্ষের শেষ। পুরাতন আমার আপন
শ্লথবৃন্ত ফলের মতন
ছিন্ন হয়ে আসিতেছে। অনুভব তারি
আপনারে দিতেছে বিস্তারি
আমার সকল-কিছু-মাঝে
প্রচ্ছন্ন বিরাজে
নিগূঢ় অন্তরে যেই একা,
চেয়ে আছি পাই যদি দেখা।
পশ্চাতের কবি
মুছিয়া করিছে ক্ষীণ আপন হাতের আঁকা ছবি।
সুদূর সম্মুখে সিন্ধু, নিঃশব্দ রজনী,
তারি তীর হতে আমি আপনারি শুনি পদধ্বনি।
অসীম পথের পান্থ, এবার এসেছি ধরা-মাঝে
মর্তজীবনের কাজে।
সে পথের 'পরে
ক্ষণে ক্ষণে অগোচরে
সকল পাওয়ার মধ্যে পেয়েছি অমূল্য উপাদেয়
এমন সম্পদ যাহা হবে মোর অক্ষয় পাথেয়।
মন বলে, আমি চলিলাম,
রেখে যাই আমার প্রণাম
তাঁদের উদ্দেশে যাঁরা জীবনের আলো
ফেলেছেন পথে যাহা বারে বারে সংশয় ঘুচালো।






 #81

কাঁচা আম 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তিনটে কাঁচা আম পড়ে ছিল গাছতলায়
চৈত্রমাসের সকালে মৃদু রোদ্‌দুরে ।
যখন-দেখলুম অস্থির ব্যগ্রতায়
হাত গেল না কুড়িয়ে নিতে ।
তখন চা খেতে খেতে মনে ভাবলুম ,
বদল হয়েছে পালের হাওয়া
পুব দিকের খেয়ার ঘাট ঝাপসা হয়ে এলে ।
সেদিন গেছে যেদিন দৈবে-পাওয়া দুটি-একটি কাঁচা আম
ছিল আমার সোনার চাবি ,
খুলে দিত সমস্ত দিনের খুশির গোপন কুঠুরি ;
আজ সে তালা নেই , চাবিও লাগে না ।


গোড়াকার কথাটা বলি ।
আমার বয়সে এ বাড়িতে যেদিন প্রথম আসছে বউ
পরের ঘর থেকে ,
সেদিন যে-মনটা ছিল নোঙর-ফেলা নৌকো
বান ডেকে তাকে দিলে তোলপাড় করে ।
জীবনের বাঁধা বরাদ্দ ছাপিয়ে দিয়ে
এল অদৃষ্টের বদান্যতা ।
পুরোনো ছেঁড়া আটপৌরে দিনরাত্রিগুলো
খসে পড়ল সমস্ত বাড়িটা থেকে ।
কদিন তিনবেলা রোশনচৌকিতে
চার দিকের প্রাত্যহিক ভাষা দিল বদলিয়ে ;
ঘরে ঘরে চলল আলোর গোলমাল
ঝাড়ে লণ্ঠনে ।
অত্যন্ত পরিচিতের মাঝখানে
ফুটে উঠল অত্যন্ত আশ্চর্য ।
কে এল রঙিন সাজে সজ্জায় ,
আলতা-পরা পায়ে পায়ে —
ইঙ্গিত করল যে , সে এই সংসারের পরিমিত দামের মানুষ নয় —
সেদিন সে ছিল একলা অতুলনীয় ।
বালকের দৃষ্টিতে এই প্রথম প্রকাশ পেল —
জগতে এমন কিছু যাকে দেখা যায় কিন্তু জানা যায় না ।
বাঁশি থামল , বাণী থামল না —
আমাদের বধূ রইল
বিস্ময়ের অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে ঘেরা ।


তার ভাব , তার আড়ি , তার খেলাধুলো ননদের সঙ্গে ।
অনেক সংকোচে অল্প একটু কাছে যেতে চাই ,
তার ডুরে শাড়িটি মনে ঘুরিয়ে দেয় আবর্ত ;
কিন্তু , ভ্রূকুটিতে বুঝতে দেরি হয় না , আমি ছেলেমানুষ ,
আমি মেয়ে নই , আমি অন্য জাতের ।
তার বয়স আমার চেয়ে দুই-এক মাসের
বড়োই হবে বা ছোটোই হবে ।
তা হোক , কিন্তু এ কথা মানি ,
আমরা ভিন্ন মসলায় তৈরি ।
মন একান্তই চাইত , ওকে কিছু একটা দিয়ে
সাঁকো বানিয়ে নিতে ।
একদিন এই হতভাগা কোথা থেকে পেল
কতকগুলো রঙিন পুথি ;
ভাবলে , চমক লাগিয়ে দেবে ।
হেসে উঠল সে ; বলল ,
“ এগুলো নিয়ে করব কী । ”
ইতিহাসের উপেক্ষিত এই-সব ট্র্যাজেডি
কোথাও দরদ পায় না ,
লজ্জার ভারে বালকের সমস্ত দিনরাত্রির
দেয় মাথা হেঁট করে ।
কোন্‌ বিচারক বিচার করবে যে , মূল্য আছে
সেই পুঁথিগুলোর ।


তবু এরই মধ্যে দেখা গেল , শস্তা খাজনা চলে
এমন দাবিও আছে ওই উচ্চাসনার —
সেখানে ওর পিড়ে পাতা মাটির কাছে ।
ও ভালোবাসে কাঁচা আম খেতে
শুল্পো শাক আর লঙ্কা দিয়ে মিশিয়ে ।
প্রসাদলাভের একটি ছোট্ট দরজা খোলা আছে
আমার মতো ছেলে আর ছেলেমানুষের জন্যেও ।


গাছে চড়তে ছিল কড়া নিষেধ ।
হাওয়া দিলেই ছুটে যেতুম বাগানে ,
দৈবে যদি পাওয়া যেত একটিমাত্র ফল
একটুখানি দুর্লভতার আড়াল থেকে ,
দেখতুম , সে কী শ্যামল , কী নিটোল , কী সুন্দর ,
প্রকৃতির সে কী আশ্চর্য দান ।
যে লোভী চিরে চিরে ওকে খায়
সে দেখতে পায় নি ওর অপরূপ রূপ ।


একদিন শিলবৃষ্টির মধ্যে আম কুড়িয়ে এনেছিলুম ;
ও বলল , “ কে বলেছে তোমাকে আনতে । ”
আমি বললুম , “ কেউ না । ”
ঝুড়িসুদ্ধ মাটিতে ফেলে চলে গেলুম ।
আর-একদিন মৌমাছিতে আমাকে দিলে কামড়ে ;
সে বললে , “ এমন করে ফল আনতে হবে না । ”
চুপ করে রইলুম ।

বয়স বেড়ে গেল ।
একদিন সোনার আংটি পেয়েছিলুম ওর কাছ থেকে ;
তাতে স্মরণীয় কিছু লেখাও ছিল ।
স্নান করতে সেটা পড়ে গেল গঙ্গার জলে —
খুঁজে পাই নি ।
এখনো কাঁচা আম পড়ছে খসে খসে
গাছের তলায় , বছরের পর বছর ।
ওকে আর খুঁজে পাবার পথ নেই ।






 #82

কাগজের নৌকা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি।
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,
লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম
বড়ো বড়ো ক'রে মোটা অক্ষরে
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকাখানি ।।


আমার নৌকা সাজাই যতনে
শিউলি বকুলে ভরি।
বাড়ির বাগানে গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়,
শিশিরের জল করে ঝলমল্‌
প্রভাতের আলো পড়ি।
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা
কোন্‌ দিক-পানে চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে -
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী বেয়ে ।।


আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে।
ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে ।
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো -
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,
কোন দেশে গিয়ে লাগে।
ঐ মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে ।।


বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে টানি
আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোনে মিশি,
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি,
কোথা কোন্‌ গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি ।
কোন্‌ পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
ধ'রে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে -
ধায় নব নব দেশে।
কাগজের তরী, তারি 'পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে ।।


রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই হাতে -
চোখ বুঁজে ভাবি এমন আঁধার,
কালী দিয়ে ঢালা নদীর দুধার -
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে রাতে।
আকাশের তারা মিটি মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,
তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে ভাসি।
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে
ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি ।।






 #83

কাঠের সিঙ্গি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ছোটো কাঠের সিঙ্গি আমার ছিল ছেলেবেলায়,
সেটা নিয়ে গর্ব ছিল বীরপুরুষি খেলায়।
গলায় বাঁধা রাঙা ফিতের দড়ি,
চিনেমাটির ব্যাঙ বেড়াত পিঠের উপর চড়ি।
ব্যাঙটা যখন পড়ে যেত ধম্‌কে দিতেম কষে,
কাঠের সিঙ্গি ভয়ে পড়ত বসে।
গাঁ গাঁ করে উঠছে বুঝি, যেমনি হত মনে,
"চুপ করো" যেই ধম্‌কানো আর চম্‌কাত সেইখনে।
আমার রাজ্যে আর যা থাকুক সিংহভয়ের কোনো
সম্ভাবনা ছিল না কখ্‌খোনো।
মাংস ব'লে মাটির ঢেলা দিতেম ভাঁড়ের 'পরে,
আপত্তি ও করত না তার তরে।
বুঝিয়ে দিতেম, গোপাল যেমন সুবোধ সবার চেয়ে
তেমনি সুবোধ হওয়া তো চাই যা দেব তাই খেয়ে।
ইতিহাসে এমন শাসন করে নি কেউ পাঠ,
দিবানিশি কাঠের সিঙ্গি ভয়েই ছিল কাঠ।
খুদি কইত মিছিমিছি, "ভয় করছে, দাদা।"
আমি বলতেম, "আমি আছি, থামাও তোমার কাঁদা--
যদি তোমায় খেয়েই ফেলে এমনি দেব মার
দু চক্ষে ও দেখবে অন্ধকার।"
মেজ্‌দিদি আর ছোড়্‌দিদিদের খেলা পুতুল নিয়ে,
কথায় কথায় দিচ্ছে তাদের বিয়ে
নেমন্তন্ন করত যখন যেতুম বটে খেতে,
কিন্তু তাদের খেলার পানে চাইনি কটাক্ষেতে।
পুরুষ আমি, সিঙ্গিমামা নত পায়ের কাছে,
এমন খেলার সাহস বলো ক'জন মেয়ের আছে।






 #84

কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা,
তারি মধ্যে চিরজীবন বইব গানের ডালা—
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা?।

তাই কি আমার ঘুম ছুটেছে, বাঁধ টুটেছে মনে,
খ্যাপা হাওয়ার ঢেউ উঠেছে চিরব্যথার বনে,
কাঁপে আমার দিবানিশার সকল আঁধার আলা!
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা?।

রাতের বাসা হয়্নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি,
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি।
শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন-মাঝে,
অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে।
নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা—
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা?।






 #85

কাল প্রাতে মোর জন্মদিন 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কাল প্রাতে মোর জন্মদিনে
এ শৈল-আতিথ্যবাসে
বুদ্ধের নেপালী ভক্ত এসেছিল মোর বার্তা শুনে।
ভূতলে আসন পাতি
বুদ্ধের বন্দনামন্ত্র শুনাইল আমার কল্যাণে--
গ্রহণ করিনু সেই বাণী।
এ ধারায় জন্ম নিয়ে যে মহামানব
সব মানবের জন্ম সার্থক করেছে একদিন,
মানুষের জন্মক্ষণ হতে
নারায়ণী এ ধরণী
যাঁর আবির্ভাব লাগি অপেক্ষা করেছে বহু যুগ,
যাঁহাতে প্রত্যক্ষ হল ধরায় সৃষ্টির অভিপ্রায়,
শুভক্ষণে পুণ্যমন্ত্রে
তাঁহারে স্মরণ করি জানিলাম মনে--
প্রবেশি মানবলোকে আশি বর্ষ আগে
এই মহাপুরুষের পুণ্যভাগী হয়েছি আমিও।






 #86

কালো অন্ধকারের তলায় 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কালো অন্ধকারের তলায়
পাখির শেষ গান গিয়েছে ডুবে।
বাতাস থমথমে,
গাছের পাতা নড়ে না,
স্বচ্ছরাত্রের তারাগুলি
যেন নেমে আসছে
পুরাতন মহানিম গাছের
ঝিল্লি-ঝংকৃত স্তব্ধ রহস্যের কাছাকাছি।
এমন সময়ে হঠাৎ আবেগে
আমার হাত ধরলে চেপে;
বললে, "তোমাকে ভুলব না কোনোদিনই।"
দীপহীন বাতায়নে
আমার মূর্তি ছিল অস্পষ্ট,
সেই ছায়ার আবরণে
তোমার অন্তরতম আবেদনের
সংকোচ গিয়েছিল কেটে।
সেই মুহূর্তে তোমার প্রেমের অমরাবতী
ব্যাপ্ত হল অনন্ত স্মৃতির ভূমিকায়।
সেই মুহূর্তের আনন্দবেদনা
বেজে উঠল কালের বীণায়,
প্রসারিত হল আগামী জন্মজন্মান্তরে।
সেই মুহূর্তে আমার আমি
তোমার নিবিড় অনুভবের মধ্যে
পেল নিঃসীমতা।
তোমার কম্পিত কণ্ঠের বাণীটুকুতে
সার্থক হয়েছে আমার প্রাণের সাধনা,
সে পেয়েছে অমৃত।
তোমার সংসারে অসংখ্য যা-কিছু আছে
তার সবচেয়ে অত্যন্ত ক'রে আছি আমি,
অত্যন্ত বেঁচে।
এই নিমেষটুকুর বাইরে আর যা-কিছু
সে গৌণ।
এর বাইরে আছে মরণ,
একদিন রূপের আলো-জ্বালা রঙ্গমঞ্চ থেকে
সরে যাব নেপথ্যে।
প্রত্যক্ষ সুখদুঃখের জগতে
মূর্তিমান অসংখ্যতার কাছে
আমার স্মরণচ্ছায়া মানবে পরাভব।
তোমার দ্বারের কাছে আছে যে কৃষ্ণচূড়া
যার তলায় দুবেলা জল দাও আপন হাতে,
সেও প্রধান হয়ে উঠে'
তার ডালপালার বাইরে
সরিয়ে রাখবে আমাকে
বিশ্বের বিরাট অগোচরে।
তা হোক,
এও গৌণ।




রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা

 #87

কালো ঘোড়া 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কালো অশ্ব অন্তরে যে সারারাত্রি ফেলেছে নিশ্বাস
সে আমার অন্ধ অভিলাষ।
অসাধ্যের সাধনায় ছুটে যাবে ব'লে
দুর্গমেরে দ্রুত পায়ে দ'লে
খুরে খুরে খুঁড়েছে ধরণী,
করেছে অধীর হ্রেষাধ্বনি।


ও যেন রে যুগান্তের কালো অগ্নিশিখা,
কালো কুজ্ঝটিকা।
অকস্মাৎ নৈরাশ্য-আঘাতে
দ্বার মুক্ত পেয়ে রাতে
দুর্দাম এসেছে বাহিরিয়া।
যারে নিয়ে এল সে-যে ব্যথায় মূর্তিত মোর প্রিয়া,
বাহিরে না স্থান পেয়ে
ধ্যানের আসন ছিল ছেয়ে।


এ-অমাবস্যায়
বল্গাহারা কালো অশ্ব ঊর্ধ্বশ্বাসে ধায়।
কালো চিন্তা মম
আত্মঘাতী ঝঞ্ঝাসম
বিস্মৃতির চিরবিলুপ্তিতে
চলে ঝাঁপ দিতে
নিরঙ্কিত পথ বেয়ে।
যাক ধেয়ে।
সৃষ্টিহীন দৃষ্টিহীন রাত্রিপারে
ব্যর্থ দুরাশারে
নিয়ে যাক্‌--
অন্তিম শূন্যের মাঝে নিশ্চল নির্বাক্‌।
তার পরে বিরহের অগ্নিস্নানে শুভ্র মন
রৌদ্রস্নাত আশ্বিনের বৃষ্টিশূন্য মেঘের মতন
উন্মুক্ত আলোকে
দীপ্তি পাক্‌ সুনির্মল শোকে।






 #88

কাশী 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কাশীর গল্প শুনেছিলুম যোগীনদাদার কাছে,
পষ্ট মনে আছে।
আমরা তখন ছিলাম না কেউ, বয়েস তাঁহার সবে
বছর-আষ্টেক হবে।
সঙ্গে ছিলেন খুড়ি,
মোরব্বা বানাবার কাজে ছিল না তাঁর জুড়ি।
দাদা বলেন, আমলকি বেল পেঁপে সে তো আছেই,
এমন কোনো ফল ছিল না এমন কোনো গাছেই
তাঁর হাতে রস জমলে লোকের গোল না ঠেকত--এটাই
ফল হবে কি মেঠাই।
রসিয়ে নিয়ে চালতা যদি মুখে দিতেন গুঁজি
মনে হত বড়োরকম রসগোল্লাই বুঝি।
কাঁঠাল বিচিত্র মোরব্বা যা বানিয়ে দিতেন তিনি
পিঠে ব'লে পৌষমাসে সবাই নিত কিনি।
দাদা বলেন, "মোরব্বাটা হয়তো মিছেমিছিই,
কিন্তু মুখে দিতে যদি, বলতে কাঁঠাল বিচিই।"
মোরব্বাতে ব্যাবসা গেল জ'মে
বেশ কিঞ্চিৎ টাকা জমল ক্রমে।
একদিন এক চোর এসেছে তখন অনেক রাত,
জানলা দিয়ে সাবধানে সে বাড়িয়ে দিল হাত।
খুড়ি তখন চাটনি করতে তেল নিচ্ছেন মেপে,
ধড়াস করে চোরের হাতে জানলা দিলেন চেপে।
চোর বললে, "উহু উহু'; খুড়ি বললেন, "আহা,
বাঁ হাত মাত্র, এইখানেতেই থেকে যাক-না তাহা।'
কেঁদে-কেটে কোনোমতে চোর তো পেল খালাস;
খুড়ি বললেন, "মরবি, যদি এ ব্যাবসা তোর চালাস।'


দাদা বললেন, "চোর পালালো, এখন গল্প থামাই,
ছ'দিন হয়নি ক্ষৌর করা, এবার গিয়ে কামাই।"
আমরা টেনে বসাই; বলি, "গল্প কেন ছাড়বে।"
দাদা বলেন, "রবার নাকি, টানলেই কি বাড়বে।--
কে ফেরাতে পারে তোদের আবদারের এই জোর,
তার চেয়ে যে অনেক সহজ ফেরানো সেই চোর।
আচ্ছা তবে শোন্‌, সে মাসে গ্রহণ লাগল চাঁদে,
শহর যেন ঘিরল নিবিড় মানুষ বোনা ফাঁদে।
খুড়ি গেছেন স্নান করতে বাড়ির দ্বারের পাশে,
আমার তখন পূর্ণগ্রহণ ভিড়ের রাহুগ্রাসে।
প্রাণটা যখন কণ্ঠাগত, মরছি যখন ডরে,
গুণ্ডা এসে তুলে নিল হঠাৎ কাঁধের 'পরে।
তখন মনে হল, এ তো বিষ্ণুদূতের দয়া,
আর-একটু দেরি হলেই প্রাপ্ত হতেম গয়া।
বিষ্ণুদূতটা ধরল যখন যমদূতের মূর্তি
এক নিমেষেই একেবারেই ঘুচল আমার ফুর্তি।
সাত গলি সে পেরিয়ে শেষে একটা এঁধোঘরে
বসিয়ে আমায় রেখে দিল খড়ের আঁঠির 'পরে।
চৌদ্দ আনা পয়সা আছে পকেট দেখি ঝেড়ে,
কেঁদে কইলাম, "ও পাঁড়েজি, এই নিয়ে দাও ছেড়ে।'
গুণ্ডা বলে, "ওটা নেব, ওটা ভালো দ্রব্যই,
আরো নেব চারটি হাজার নয়শো নিরেনব্বই--
তার উপরে আর দু আনা, খুড়িটা তো মরবে,
টাকার বোঝা বয়ে সে কি বৈতরণী তরবে।
দেয় যদি তো দিক চুকিয়ে, নইলে--' পাকিয়ে চোখ
যে ভঙ্গিটা দেখিয়ে দিলে সেটা মারাত্মক।


এমনসময়, ভাগ্যি ভালো, গুণ্ডাজির এক ভাগ্নি
মূর্তিটা তার রণচণ্ডী, যেন সে রায়বাঘ্‌নি,
আমার মরণদশার মধ্যে হলেন সমাগত
দাবানলের ঊর্ধ্বে যেন কালো মেঘের মতো।
রাত্তিরে কাল ঘরে আমার উঁকি মারল বুঝি,
যেমনি দেখা অমনি আমি রইনু চক্ষু বাজি।
পরের দিনে পাশের ঘরে, কী গলা তার বাপ,
মামার সঙ্গে ঠাণ্ডা ভাষায় নয় সে বাক্যালাপ।
বলছে, "তোমার মরণ হয় না, কাহার বাছনি ও,
পাপের বোঝা বাড়িয়ো না আর, ঘরে ফেরৎ দিয়ো--
আহা, এমন সোনার টুকরো--' শুনে আগুন মামা;
বিশ্রী রকম গাল দিয়ে কয়, "মিহি সুরটা থামা।'
এ'কেই বলে মিহি সুর কি, আমি ভাবছি শুনে।
দিন তো গেল কোনোমতে কড়ি বর্‌গা গুনে।
রাত্রি হবে দুপুর, ভাগ্নি ঢুকল ঘরে ধীরে;
চুপি চুপি বললে কানে, "যেতে কি চাস ফিরে।'
লাফিয়ে উঠে কেঁদে বললেম, "যাব যাব যাব।'
ভাগ্নি বললে, "আমার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নাবো--
কোথায় তোমার খুড়ির বাসা অগস্ত্যকুণ্ডে কি,
যে ক'রে হোক আজকে রাতেই খুঁজে একবার দেখি;
কালকে মামার হাতে আমার হবেই মুণ্ডপাত।'--
আমি তো, ভাই, বেঁচে গেলেম, ফুরিয়ে গেল রাত।


হেসে বললেম যোগীনদাদার গম্ভীর মুখ দেখে,
ঠিক এমনি গল্প বাবা শুনিয়েছে বই থেকে।
দাদা বললেন, "বিধি যদি চুরি করেন নিজে
পরের গল্প, জানিনে ভাই, আমি করব কী যে।'






 #89

কুমার 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কুমার, তোমার প্রতীক্ষা করে নারী,
অভিষেক-তরে এনেছে তীর্থবারি।
সাজাবে অঙ্গ উজ্জ্বল বরবেশে,
জয়মাল্য-যে পরাবে তোমার কেশে,
বরণ করিবে তোমারে সে-উদ্দেশে
দাঁড়ায়েছে সারি সারি।


দৈত্যের হাতে স্বর্গের পরাভবে
বারে বারে, বীর, জাগ ভয়ার্ত ভবে।
ভাই ব'লে তাই নারী করে আহ্বান,
তোমারে রমণী পেতে চাহে সন্তান,
প্রিয় ব'লে গলে করিবে মাল্য দান
আনন্দে গৌরবে।


হেরো, জাগে সে যে রাতের প্রহর গণি,
তোমার বিজয়শঙ্খ উঠুক ধ্বনি।
গর্জিত তব তর্জনধিক্কারে
লজ্জিত করো কুৎসিত ভীরুতারে,
মন্দ্রিত হোক বন্দীশালার দ্বারে
মুক্তির জাগরণী।


তুমি এসে যদি পাশে নাহি দাও স্থান,
হে কিশোর, তাহে নারীর অসম্মান।
তব কল্যাণে কুঙ্কুম তার ভালে,
তব প্রাঙ্গণে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালে,
তব বন্দনে সাজায় পূজার থালে
প্রাণের শ্রেষ্ঠ দান।


তুমি নাই, মিছে বসন্ত আসে বনে
বিরহবিকল চঞ্চল সমীরণে।
দুর্বল মোহ কোন আয়োজন করে
যেথা অরাজক হিয়া লজ্জায় মরে--
ওই ডাকে, রাজা, এসো এ শূন্য ঘরে
হৃদয়সিংহাসনে।


চেয়ে আছে নারী, প্রদীপ হয়েছে জ্বালা--
বিফল কোরো না বীরের বরণডালা।
মিলনলগ্ন বারে বারে ফিরে যায়
বরসজ্জার ব্যর্থতাবেদনায়,
মনে মনে সদা ব্যথিত কল্পনায়
তোমারে পরায় মালা।


তব রথ তারা স্বপ্নে দেখিছে জেগে,
ছুটিছে অশ্ব বিদ্যুৎকশা লেগে।
ঘুরিছে চক্র বহ্নিবরন সে যে,
উঠিছে শূন্যে ঘর্ঘর তার বেজে,
প্রোজ্জ্বল চূড়া প্রভাতসূর্যতেজে,
ধ্বজা রঞ্জিত রাঙা সন্ধ্যার মেঘে।


উদ্দেশহীন দুর্গম কোন্‌খানে
চল দুঃসহ দুঃসাহসের টানে।
দিল আহ্বান আলসনিদ্রা-নাশা
উদয়কূলের শৈলমূলের বাসা,
অমরালোকের নব আলোকের ভাষা
দীপ্ত হয়েছে দৃপ্ত তোমার প্রাণে।


অদূরে সুনীল সাগরে ঊর্মিরাশি
উত্তালবেগে উঠিছে সমুচ্ছ্বাসি।
পথিক ঝটিকা রুদ্রের অভিসারে
উধাও ছুটিছে সীমাসমুদ্রপারে,
উল্লোল কলগর্জিত পারাবারে
ফেনগর্গরে ধ্বনিছে অট্টহাসি।


আত্মলোপের নিত্যনিবিড় কারা,
তুমি উদ্দাম সেই বন্ধনহারা।
কোনো শঙ্কার কার্মূকটংকারে
পারে না তোমারে বিহ্বল করিবারে,
মৃত্যুর ছায়া ভেদিয়া তিমিরপারে
নির্ভয়ে ধাও যেথা জ্বলে ধ্রুবতারা।


চাহে নারী তব রথসঙ্গিনী হবে,
তোমার ধনুর তূণ চিহ্নিয়া লবে।
অবারিত পথে আছে আগ্রহভরে
তব যাত্রায় আত্মদানের তরে,
গ্রহণ করিয়ো সম্মানে সমাদরে--
জাগ্রত করি রাখিয়ো শঙ্খরবে।






 #90

কৃপণা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এসেছিনু দ্বারে ঘনবর্ষণ রাতে,
প্রদীপ নিবালে কেন অঞ্চলাঘাতে।
কালো ছায়াখানি মনে পড়ে গেল আঁকা,
বিমুখ মুখের ছবি অন্তরে ঢাকা,
কলঙ্করেখা যেন
চিরদিন চাঁদ বহি চলে সাথে সাথে।

কেন বাধা হল দিতে মাধুরীর কণা
হায় হায়, হে কৃপণ্য।
তব যৌবন-মাঝে
লাবণ্য বিরাজে,
লিপিখানি তার নিয়ে এসে তবু
কেন যে দিলে না হাতে।






 #91
কৃষ্ণকলি 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

পূবে বাতাস এল হঠাত্‍‌ ধেয়ে,
ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,
আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

এমনি করে কাজল কালো মেঘ
জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ়মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাত্‍‌ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।


 #93

কেউ চেনা নয় 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কেউ চেনা নয়
সব মানুষই অজানা।
চলেছে আপনার রহস্যে
আপনি একাকী।
সেখানে তার দোসর নেই।
সংসারের ছাপমারা কাঠামোয়
মানুষের সীমা দিই বানিয়ে।
সংজ্ঞার বেড়া-দেওয়া বসতির মধ্যে
বাঁধা মাইনের কাজ করে সে।
থাকে সাধারণের চিহ্ন নিয়ে ললাটে।
এমন সময় কোথা থেকে
ভালোবাসার বসন্ত-হাওয়া লাগে,
সীমার আড়ালটা যায় উড়ে,
বেরিয়ে পড়ে চির-অচেনা।
সামনে তাকে দেখি স্বয়ংস্বতন্ত্র, অপূর্ব, অসাধারণ,
তার জুড়ি কেউ নেই।
তার সঙ্গে যোগ দেবার বেলায়
বাঁধতে হয় গানের সেতু,
ফুলের ভাষায় করি তার অভ্যর্থনা।
চোখ বলে,
যা দেখলুম, তুমি আছ তাকে পেরিয়ে।
মন বলে
চোখে-দেখা কানে-শোনার ওপারে যে রহস্য
তুমি এসেছ সেই অগমের দূত,--
রাত্রি যেমন আসে
পৃথিবীর সামনে নক্ষত্রলোক অবারিত ক'রে।
তখন হঠাৎ দেখি আমার মধ্যেকার অচেনাকে,
তখন আপন অনুভবের
তল খুঁজে পাইনে,
সেই অনুভব
"তিলে তিলে নূতন হোয়।"






 #94

কেন 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


জ্যোতিষীরা বলে,
সবিতার আত্মদান-যজ্ঞের হোমাগ্নিবেদিতলে
যে জ্যোতি উৎসর্গ হয় মহারুদ্রতপে
এ বিশ্বের মন্দিরমণ্ডপে,
অতিতুচ্ছ অংশ তার ঝরে
পৃথিবীর অতিক্ষুদ্র মৃৎপাত্রের 'পরে।
অবশিষ্ট অমেয় আলোকধারা
পথহারা,
আদিম দিগন্ত হতে
অক্লান্ত চলেছে ধেয়ে নিরুদ্দেশ স্রোতে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়াছে অপার তিমির-তেপান্তরে
অসংখ্য নক্ষত্র হয়ে রশ্মিপ্লাবী নিরন্ত নির্ঝরে
সর্বত্যাগী অপব্যয়,
আপন সৃষ্টির 'পরে বিধাতার নির্মম অন্যায়।
কিংবা এ কি মহাকাল কল্পকল্পান্তের দিনে রাতে
এক হাতে দান ক'রে ফিরে ফিরে নেয় অন্য হাতে।
সঞ্চয়ে ও অপচয়ে যুগে যুগে কাড়াকাড়ি যেন--
কিন্তু, কেন।
তার পরে চেয়ে দেখি মানুষের চৈতন্যজগতে
ভেসে চলে সুখদুঃখ কল্পনাভাবনা কত পথে।
কোথাও বা জ্ব'লে ওঠে জীবন-উৎসাহ,
কোথাও বা সভ্যতার চিতাবহ্নিদাহ
নিভে আসে নিঃস্বতার ভস্ম-অবশেষে।
নির্ঝর ঝরিছে দেশে দেশে--
লক্ষ্যহীন প্রাণস্রোতে মৃত্যুর গহ্বরে ঢালে মহী
বাসনার বেদনার অজস্র বুদ্বুদপুঞ্জ বহি।
কে তার হিসাব রাখে লিখি।
নিত্য নিত্য এমনি কি
অফুরান আত্মহত্যা মানবসৃষ্টির
নিরন্তর প্রলয়বৃষ্টির
অশ্রান্ত প্লাবনে।
নিরর্থক হরণে ভরণে
মানুষের চিত্ত নিয়ে সারাবেলা
মহাকাল করিতেছে দ্যূতখেলা
বাঁ হাতে দক্ষিণ হাতে যেন--
কিন্তু, কেন।
প্রথম বয়সে কবে ভাবনার কী আঘাত লেগে
এ প্রশ্নই মনে উঠেছিল জেগে--
শুধায়েছি, এ বিশ্বের কোন্‌ কেন্দ্রস্থলে
মিলিতেছে প্রতি দণ্ডে পলে
অরণ্যের পর্বতের সমুদ্রের উল্লোল গর্জন,
ঝটিকার মন্দ্রস্বন,
দিবসনিশার
বেদনাবীণার তারে চেতনার মিশ্রিত ঝংকার,
পূর্ণ করি ঋতুর উৎসব
জীবনের মরণের নিত্যকলরব,
আলোকের নিঃশব্দ চরণপাত
নিয়ত স্পন্দিত করি দ্যুলোকের অস্তহীন রাত।
কল্পনায় দেখেছিনু, প্রতিধ্বনিমণ্ডল বিরাজে
ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরকন্দর-মাঝে।
সেথা বাঁধে বাসা
চতুর্দিক হতে আসি জগতের পাখা-মেলা ভাষা।
সেথা হতে পুরানো স্মৃতিরে দীর্ণ করি
সৃষ্টির আরম্ভবীজ লয় ভরি ভরি
আপনার পক্ষপুটে ফিরে-চলা যত প্রতিধ্বনি।
অনুভব করেছি তখনি,
বহু যুগযুগান্তের কোন্‌ এক বাণীধারা
নক্ষত্রে নক্ষত্রে ঠেকি পথহারা
সংহত হয়েছে অবশেষে
মোর মাঝে এসে।
প্রশ্ন মনে আসে আরবার,
আবার কি ছিন্ন হয়ে যাবে সূত্র তার--
রূপহারা গতিবেগ প্রেতের জগতে
চলে যাবে বহু কোটি বৎসরের শূন্য যাত্রাপথে?
উজাড় করিয়া দিবে তার
পান্থের পাথেয়পত্র আপন স্বল্পায়ু বেদনার--
ভোজশেষে উচ্ছিষ্টের ভাঙা ভাণ্ড হেন?
কিন্তু, কেন।






 #95

কো তুঁহু বোলবি মোয় 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কো তুঁহু বোলবি মোয় !
হৃদয়মাহ মঝু জাগসি অনুখন ,
আঁখউপর তুঁহু রচলহি আসন ,
অরুণ নয়ন তব মরমসঙে মম
নিমিখ ন অন্তর হোয় ।
কো তুঁহু বোলবি মোয় !

হৃদয়কমল তব চরণে টলমল ,
নয়নযুগল মম উছলে ছলছল ,
প্রেমপূর্ণ তনু পুলকে ঢলঢল
চাহে মিলাইতে তোয় ।
কো তুঁহু বোলবি মোয় !

বাঁশরিধ্বনি তুহ অমিয় গরল রে ,
হৃদয় বিদারয়ি হৃদয় হরল রে ,
আকুল কাকলি ভুবন ভরল রে ,
উতল প্রাণ উতরোয় ।
কো তুঁহু বোলবি মোয় !

হেরি হাসি তব মধুঋতু ধাওল ,
শুনয়ি বাঁশি তব পিককুল গাওল ,
বিকল ভ্রমরসম ত্রিভুবন আওল ,
চরণকমলযুগ ছোঁয় ।
কো তুহু বোলবি মোয় !

গোপবধূজন বিকশিতযৌবন ,
পুলকিত যমুনা , মুকুলিত উপবন ,
নীলনীর'পর ধীর সমীরণ ,
পলকে প্রাণমন খোয়
কো তুঁহু বোলবি মোয় !
তৃষিত আঁখি , তব মুখ'পর বিহরই ,
মধুর পরশ তব রাধা শিহরই ,
প্রেমরতন ভরি হৃদয় প্রাণ লই
পদতলে অপনা থোয় ।
কো তুঁহু বোলবি মোয় !

কো তুঁহু কো তুঁহু সব জন পুছয়ি ,
অনুদিন সঘন নয়নজল মুছয়ি ,
যাচে ভানু , সব সংশয় ঘুচয়ি ,
জনম চরণ'পর গোয় ।
কো তুঁহু বোলবি মোয় !






 #96

কোপাই 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


পদ্মা কোথায় চলেছে দূর আকাশের তলায়,
মনে মনে দেখি তাকে।
এক পারে বালুর চর,
নির্ভীক কেননা নিঃস্ব, নিরাসক্ত,-
অন্য পারে বাঁশবন, আমবন,
পুরোনো বট, পোড়ো ভিটে,
অনেক দিনের গুড়ি-মোটা কাঁঠালগাছ-
পুকুরের ধারে সর্ষেখেত,
পথের ধারে বেতের জঙ্গল,
দেড়শো বছর আগেকার নীলকুঠির ভাঙা ভিত,
তার বাগানে দীর্ঘ ঝাউগাছে দিনরাত মর্মরধ্বনি।
ঐখানে রাজবংশীদের পাড়া,
ফাটল-ধরা খেতে ওদের ছাগল চরে,
হাটের কাছে টিনের ছাদওয়ালা গঞ্জ-
সমস্ত গ্রাম নির্মম নদীর ভয়ে কম্পান্বিত।

পুরাণে প্রসিদ্ধ এই নদীর নাম,
মন্দাকিনীর প্রবাহ ওর নাড়ীতে।
ও স্বতন্ত্র। লোকালয়ের পাশ দিয়ে চলে যায়,
তাদের সহ্য করে, স্বীকার করে না।
বিশুদ্ধ তার আভিজাতিক ছন্দে
এক দিকে নির্জন পর্বতের স্মৃতি, আর-এক দিকে নিঃসঙ্গ সমুদ্রের আহ্বান।

একদিন ছিলেম ওরি চরের ঘাটে,
নিভৃতে, সবার হতে বহুদূরে।
ভোরের শুকতারাকে দেখে জেঘেছি,
ঘুমিয়েছি রাতে সপ্তর্ষির দৃষ্টির সম্মুখে
নৌকার ছাদের উপর।
আমার একলা দিন-রাতের নানা ভাবনার ধারে ধারে
চলে গেছে ওর উদাসীর ধারা-
পথিক যেমন চলে যায়
গৃহস্থের সুখদুঃখের পাশ দিয়ে, অথচ দূর দিয়ে।

তার পরে যৌবনের শেষ এসেছি
তরুবিরল এই মাঠের প্রান্তে।
ছায়াবৃত সাঁওতাল-পাড়ার পুঞ্জিত সবুজ দেখা যায় অদূরে।

এখানে আমার প্রতিবেশিনী কোপাই নদী।
প্রাচীন গোত্রের গরিমা নেই তার।
অনার্য তার নামখানি
কত কালের সাঁওতাল নারীর হাস্যমুখর
কলভাষার সঙ্গে জড়িত।
গ্রামের সঙ্গে তার গলাগলি
স্থলের সঙ্গে জলের নেই বিরোধ।
তার এ পারের সঙ্গে ও পারের কথা চলে সহজে।
শণের খেতে ফুল ধরেছে একেবারে তার গায়ে গায়ে,
জেগে উঠেছে কচি কচি ধানের চারা।
রাস্তা যেখানে থেমেছে তীরে এসে
সেখানে ও পথিককে দেয় পথ ছেড়ে
কলকল স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোতের উপর দিয়ে।
অদূরে তালগাছ উঠেছে মাঠের মধ্যে,
তীরে আম জাম আমলকীল ঘেঁষাঘেঁষি।

ওর ভাষা গৃহস্থপাড়ার ভাষা-
তাকে সাধুভাষা বলে না।
জল স্থল বাঁধা পড়েছে ওর ছন্দে,
রেষারেষি নেই তরলে শ্যামলে।
ছিপছিপে ওর দেহটি
বেঁকে বেঁকে চলে ছায়ায় আলোয়
হাততাল দিয়ে সহজ নাচে।
বর্ষায় ওর অঙ্গে অঙ্গে লাগে মাতলামি
মহুয়া-মাতাল গাঁয়ের মেয়ের মতো-
ভাঙে না, ডোবায় না,
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আবর্তের ঘাঘরা
দুই তীরকে ঠেলা দিয়ে দিয়ে
উচ্চ হেসে ধেয়ে চলে।

শরতের শেষে স্বচ্ছ হয়ে আসে জল,
ক্ষীণ হয় তার ধারা,
তলার বালি চোখো পড়ে,
তখন শীর্ণ সমারোহের পাণ্ডুরতা
তাকে তো লজ্জা দিতে পারে না।
তার ধন নয় উদ্ধত, তার দৈন্য নয় মলিন;
এ দুইয়েই তার শোভা-
যেমন নটী যখন অলংকারের ঝংকার দিয়ে নাচে,
আর যখন সে নীরবে বসে থাকে ক্লান্ত হয়ে,
চোখের চাহনিতে আলস্য,
একটুকানি হাসির আভাস ঠোঁটের কোণে।
কোপাই আজ কবির ছন্দকে আপন সাথি করে নিলে,
সেই ছন্দের আপোস হয়ে গেল ভাষার স্থলে জলে.,
যেখানে ভাষার গান আর যেখানে ভাষার গৃহস্থালি।
তার ভাঙা তালে হে'টে চলে যাবে ধনুক হাতে সাঁওতাল ছেলে;
পার হয়ে যাবে গোরুর গাড়ি
আঁটি আঁটি খড় বোঝাই করে;
হাটে যাবে কুমোর
বাঁকে করে হাঁড়ি নিয়ে;
পিছন পিছন যাবে গাঁয়ের কুকুরটা;
আর, মাসিক তিন টাকা মাইনের গুরু
ছেড়া ছাতি মাথায়।





 #97

ক্যান্ডীয় নাচ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


সিংহলে সেই দেখেছিলেম ক্যান্ডিদলের নাচ;
শিকড়গুলোর শিকড় ছিঁড়ে যেন শালের গাছ
পেরিয়ে এল মুক্তিমাতাল খ্যাপা,
হুংকার তার ছুটল আকাশ-ব্যাপা।
ডালপালা সব দুড়্‌দাড়িয়ে ঘূর্ণি হাওয়ায় কহে--
নহে, নহে, নহে--
নহে বাধা, নহে বাঁধন, নহে পিছন-ফেরা,
নহে আবেগ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা,
নহে মৃদু লতার দোলা, নহে পাতার কাঁপন--
আগুন হয়ে জ্বলে ওঠা এ যে তপের তাপন।
ওদের ডেকে বলেছিল সমুদ্দরের ঢেউ,
"আমার ছন্দ রক্তে আছে এমন আছে কেউ।'
ঝঞ্ঝা ওদের বলেছিল, "মঞ্জীর তোর আছে
ঝংকারে যার লাগাবে লয় আমার প্রলয়নাচে।'
ঐ যে পাগল দেহখানা, শূন্যে ওঠে বাহু,
যেন কোথায় হাঁ করেছে রাহু--
লুব্ধ তাহার ক্ষুধার থেকে চাঁদকে করবে ত্রাণ,
পূর্ণিমাকে ফিরিয়ে দেবে প্রাণ।
মহাদেবের তপোভঙ্গে যেন বিষম বেগে
নন্দী উঠল জেগে;
শিবের ক্রোধের সঙ্গে
উঠল জ্বলে দুর্দাম তার প্রতি অঙ্গে অঙ্গে
নাচের বহ্নিশিখা
নিদয়া নির্ভীকা।
খুঁজতে ছোটে মোহমদের বাহন কোথায় আছে
দাহন করবে এই নিদারুণ আনন্দময় নাচে।
নটরাজ যে পুরুষ তিনি, তাণ্ডবে তাঁর সাধন,
আপন শক্তি মুক্ত ক'রে ছেঁড়েন আপন বাঁধন;
দুঃখবেগে জাগিয়ে তোলেন সকল ভয়ের ভয়;
জয়ের নৃত্যে আপনাকে তাঁর জয়।






 #98

ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু॥
এই-যে হিয়া থরোথরো কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥
এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
পিছন-পানে তাকাই যদি কভু।
দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায় শুকায় মালা পূজার থালায়,
সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥






 #99

খাটুলি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


একলা হোথায় বসে আছে, কেই বা জানে ওকে--
আপন-ভোলা সহজ তৃপ্তি রয়েছে ওর চোখে।
খাটুলিটা বাইরে এনে আঙিনাটার কোণে
টানছে তামাক বসে আপন-মনে।
মাথার উপর বটের ছায়া, পিছন দিকে নদী
বইছে নিরবধি।
আয়োজনের বালাই নেইকো ঘরে,
আমের কাঠের নড়্‌নড়ে এক তক্তপোষের 'পরে
মাঝখানেতে আছে কেবল পাতা
বিধবা তার মেয়ের হাতের সেলাই করা কাঁথা।
নাতনি গেছে, রাখে তারি পোষা ময়নাটাকে,
ছেলের গাঁথা ঘরের দেয়াল, চিহ্ন আছে তারি
রঙিন মাটি দিয়ে আঁকা সিপাই সারি সারি।
সেই ছেলেটাই তালুকদারের সর্দারি পদ পেয়ে
জেলখানাতে মরছে পচে দাঙ্গা করতে যেয়ে।
দুঃখ অনেক পেয়েছে ও, হয়তো ডুবছে দেনায়,
হয়তো ক্ষতি হয়ে গেছে তিসির বেচাকেনায়।
বাইরে দারিদ্র্যের
কাটা-ছেঁড়ার আঁচড় লাগে ঢের,
তবুও তার ভিতর-মনে দাগ পড়ে না বেশি,
প্রাণটা যেমন কঠিন তেমনি কঠিন মাংসপেশী।
হয়তো গোরু বেচতে হবে মেয়ের বিয়ের দায়ে,
মাসে দুবার ম্যালেরিয়া কাঁপন লাগায় গায়ে,
ডাগর ছেলে চাকরি করতে গঙ্গাপারের-দেশে
হয়তো হঠাৎ মারা গেছে ঐ বছরের শেষে--
শুকনো করুণ চক্ষু দুটো তুলে উপর-পানে
কার খেলা এই দুঃখসুখের, কী ভাবলে সেই জানে।
বিচ্ছেদ নেই খাটুনিতে, শোকের পায় না ফাঁক,
ভাবতে পারে স্পষ্ট ক'রে নেইকো এমন বাক্‌।
জমিদারের কাছারিতে নালিশ করতে এসে
কী বলবে যে কেমন ক'রে পায় না ভেবে শেষে।


খাটুলিতে এসে বসে যখনি পায় ছুটি,
ভাব্‌নাগুলো ধোঁয়ায় মেলায়, ধোঁয়ায় ওঠে ফুটি।
ওর যে আছে খোলা আকাশ, ওর যে মাথার কাছে
শিষ দিয়ে যায় বুলবুলিরা আলোছায়ার নাচে,
নদীর ধারে মেঠো পথে টাট্টু চলে ছুটে,
চক্ষু ভোলায় খেতের ফসল রঙের হরির-লুটে--
জন্মমরণ ব্যেপে আছে এরা প্রাণের ধন
অতি সহজ ব'লেই তাহা জানে না ওর মন।






 #100

খাটুলি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


একলা হোথায় বসে আছে, কেই বা জানে ওকে--
আপন-ভোলা সহজ তৃপ্তি রয়েছে ওর চোখে।
খাটুলিটা বাইরে এনে আঙিনাটার কোণে
টানছে তামাক বসে আপন-মনে।
মাথার উপর বটের ছায়া, পিছন দিকে নদী
বইছে নিরবধি।
আয়োজনের বালাই নেইকো ঘরে,
আমের কাঠের নড়্‌নড়ে এক তক্তপোষের 'পরে
মাঝখানেতে আছে কেবল পাতা
বিধবা তার মেয়ের হাতের সেলাই করা কাঁথা।
নাতনি গেছে, রাখে তারি পোষা ময়নাটাকে,
ছেলের গাঁথা ঘরের দেয়াল, চিহ্ন আছে তারি
রঙিন মাটি দিয়ে আঁকা সিপাই সারি সারি।
সেই ছেলেটাই তালুকদারের সর্দারি পদ পেয়ে
জেলখানাতে মরছে পচে দাঙ্গা করতে যেয়ে।
দুঃখ অনেক পেয়েছে ও, হয়তো ডুবছে দেনায়,
হয়তো ক্ষতি হয়ে গেছে তিসির বেচাকেনায়।
বাইরে দারিদ্র্যের
কাটা-ছেঁড়ার আঁচড় লাগে ঢের,
তবুও তার ভিতর-মনে দাগ পড়ে না বেশি,
প্রাণটা যেমন কঠিন তেমনি কঠিন মাংসপেশী।
হয়তো গোরু বেচতে হবে মেয়ের বিয়ের দায়ে,
মাসে দুবার ম্যালেরিয়া কাঁপন লাগায় গায়ে,
ডাগর ছেলে চাকরি করতে গঙ্গাপারের-দেশে
হয়তো হঠাৎ মারা গেছে ঐ বছরের শেষে--
শুকনো করুণ চক্ষু দুটো তুলে উপর-পানে
কার খেলা এই দুঃখসুখের, কী ভাবলে সেই জানে।
বিচ্ছেদ নেই খাটুনিতে, শোকের পায় না ফাঁক,
ভাবতে পারে স্পষ্ট ক'রে নেইকো এমন বাক্‌।
জমিদারের কাছারিতে নালিশ করতে এসে
কী বলবে যে কেমন ক'রে পায় না ভেবে শেষে।


খাটুলিতে এসে বসে যখনি পায় ছুটি,
ভাব্‌নাগুলো ধোঁয়ায় মেলায়, ধোঁয়ায় ওঠে ফুটি।
ওর যে আছে খোলা আকাশ, ওর যে মাথার কাছে
শিষ দিয়ে যায় বুলবুলিরা আলোছায়ার নাচে,
নদীর ধারে মেঠো পথে টাট্টু চলে ছুটে,
চক্ষু ভোলায় খেতের ফসল রঙের হরির-লুটে--
জন্মমরণ ব্যেপে আছে এরা প্রাণের ধন
অতি সহজ ব'লেই তাহা জানে না ওর মন।






 #101

খেলা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এই জগতের শক্ত মনিব সয় না একটু ত্রুটি,
যেমন নিত্য কাজের পালা তেমনি নিত্য ছুটি।
বাতাসে তার ছেলেখেলা, আকাশে তার হাসি,
সাগর জুড়ে গদ্‌গদ ভাষ বুদ্‌বুদে যায় ভাসি।
ঝরনা ছোটে দূরের ডাকে পাথরগুলো ঠেলে--
কাজের সঙ্গে নাচের খেয়াল কোথার থেকে পেলে।
ঐ হোথা শাল, পাঁচশো বছর মজ্জাতে ওর ঢাকা--
গম্ভীরতায় অটল যেমন, চঞ্চলতায় পাকা।
মজ্জাতে ওর কঠোর শক্তি, বকুনি ওর পাতায়--
ঝড়ের দিনে কী পাগলামি চাপে যে ওর মাথায়।
ফুলের দিনে গন্ধের ভোজ অবাধ সারাক্ষণ,
ডালে ডালে দখিন হাওয়ার বাঁধা নিমন্ত্রণ।






 #102

গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে ,
বিসরি ত্রাস - লোকলাজে
সজনি , আও আও লো ।
অঙ্গে চারু নীল বাস ,
হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ ,
হরিণনেত্রে বিমল হাস ,
কুঞ্জবনমে আও লো ।
ঢালে কুসুম সুরভভার ,
ঢালে বিহগ সুরবসার ,
ঢালে ইন্দু অমৃতধার
বিমল রজত ভাতি রে ।
মন্দ মন্দ ভৃঙ্গ গুঞ্জে ,
অযুত কুসুম কুঞ্জে কুঞ্জে ,
ফুটল সজনি , পুঞ্জে পুঞ্জে
বকুল যূথি জাতি রে ।
দেখ সজনি , শ্যামরায়
নয়নে প্রেম উথল যায় ,
মধুর বদন অমৃতসদন
চন্দ্রমায় নিন্দিছে ।
আও আও সজনিবৃন্দ ,
হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ,
শ্যামকো পদারবিন্দ
ভানুসিংহ বন্দিছে ।






 #103

গান 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
এতদিন তারে বুঝিতে পারি নি,
দিন চলে গেছে কুঁজিতে।
শুভখনে কাছে ডাকিলে,
লজ্জা আমার ঢাকিলে,
তোমারে পেরেছি বুঝিতে।

কে মোরে ফিরাবে অনাদরে,
কে মোরে ডাকিবে কাচে,
কাহার প্রেমের বেদনার মাঝে
আমার মূল্য আছে,
এ নিরন্তর সংশয়ে আর
পারি না কেবলি যুঝিতে--
তোমারেই শুধু সত্য পেরেছি বুঝিতে।






 #104

গান আরম্ভ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


চারি দিকে খেলিতেছে মেঘ ,
বায়ু আসি করিছে চুম্বন --
সীমাহারা নভস্তল দুই বাহু পসারিয়া
হৃদয়ে করিছে আলিঙ্গন ।
অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার !
যবে আমি আসিব হেথায়
মন্ত্র পড়ি ডাকিব তোমায় ।
বাতাসে উড়িবে তোর বাস ,
ছড়ায়ে পড়িবে কেশপাশ ,
ঈষৎ মেলিয়া আঁখি - পাতা
মৃদু হাসি পড়িবে ফুটিয়া --
হৃদয়ের মৃদুল কিরণ
অধরেতে পড়িবে লুটিয়া ।
এলো থেলো কেশপাশ লয়ে
বসে বসে , খেলিবি হেথায় ,
উষার অলক দুলাইয়া
সমীরণ যেমন খেলায় ।
চুমিয়া চুমিয়া ফুটাইব
আধোফোটা হাসির কুসুম ,
মুখ লয়ে বুকের মাঝারে
গান গেয়ে পাড়াইব ঘুম ।
কৌতুকে করিয়া কোলাকুলি
আসিবে মেঘের শিশুগুলি ,
ঘিরিয়া দাঁড়াবে তারা সবে
অবাক হইয়া চেয়ে রবে ।
মেঘ হতে নেমে ধীরে ধীরে
আয় লো কবিতা , মোর বামে --
চম্পক - অঙ্গুলি দুটি দিয়ে
অন্ধকার ধীরে সরাইয়ে
যেমন করিয়া উষা নামে ।

বায়ু হতে আয় লো কবিতা ,
আসিয়া বসিবি মোর পাশে --
কে জানে , বনের কোথা হতে
ভেসে ভেসে সমীরণস্রোতে
সৌরভ যেমন করে আসে ।
হৃদয়ের অন্তঃপুর হতে
বধূ মোর , ধীরে ধীরে আয় --
ভীরু প্রেম যেমন করিয়া
ধীরে উঠে হৃদয় ধরিয়া ,
বঁধুর পায়ের কাছে গিয়ে
অমনি মুরছি পড়ে যায় ।


অথবা শিথিল কলেবরে
এসো তুমি , বোসো মোর পাশে --
মরণ যেমন করে আসে ,
শিশির যেমন করে ঝরে ,
পশ্চিমের আঁধারসাগরে
তারাটি যেমন করে যায়
অতি ধীরে মৃদু হেসে সিঁদুর সীমন্তদেশে
দিবা সে যেমন করে আসে
মরিবারে স্বামীর চিতায়
পশ্চিমের জ্বলন্ত শিখায় ।
পরবাসী ক্ষীণ - আয়ু একটি মুমূর্ষু বায়ু
শেষ কথা বলিতে বলিতে
তখনি যেমন মরে যায়
তেমনি , তেমনি করে এসো --
কবিতা রে , বধূটি আমার ,
দুটি শুধু পড়িবে নিশ্বাস ,
দুটি শুধু বাহিরিবে বাণী ,
বাহু দুটি হৃদয়ে জড়ায়ে
মরমে রাখিব মুখখানি ।






 #105

গানভঙ্গ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


গাহিছে কাশীনাথ নবীন যুবা, ধ্বনিতে সভাগৃহ ঢাকি,
কণ্ঠে খেলিতেছে সাতটি সুর সাতটি যেন পোষা পাখি;
শানিত তরবারি গলাটি যেন নাচিয়া ফিরে দশ দিকে---
কখন কোথা যায় না পাই দিশা, বিজুলি-হেন ঝিকিমিকে।
আপনি গড়ি তোলে বিপদজাল, আপনি কাটি দেয় তাহা;
সভার লোকে শুনে অবাক মানে, সঘনে বলে `বাহা বাহা'।

কেবল বুড়া রাজা প্রতাপরায় কাঠের মতো বসি আছে;
বরজলাল ছাড়া কাহারো গান ভালো না লাগে তার কাছে।
বালক-বেলা হতে তাহারি গীতে দিল সে এতকাল যাপি---
বাদল-দিনে কত মেঘের গান, হোলির দিনে কত কাফি।
গেয়েছে আগমনী শরত্‍‌প্রাতে, গেয়েছে বিজয়ার গান---
হৃদয় উছসিয়া অশ্রুজলে ভাসিয়া গিয়াছে দুনয়ান।
যখনি মিলিয়াছে বন্ধুজনে সভার গৃহ গেছে পূরে,
গেয়েছে গোকুলের গোয়াল-গাথা ভূপালি মূলতানি সুরে।
ঘরেতে বারবার এসেছে কত বিবাহ-উত্‍‌সব-রাতি---
পরেছে দাসদাসী লোহিত বাস, জ্বলেছে শত শত বাতি,
বসেছে নব বর সলাজ মুখে পরিয়া মণি-আভরণ,
করিছে পরিহাস কানের কাছে সমবয়সী প্রিয়জন,
সামনে বসি তার বরজলাল ধরেছে সাহানার সুর---
সে-সব দিন আর সে-সব গান হৃদয়ে আছে পরিপূর।
সে ছাড়া কারো গান শুনিলেই তাই মর্মে গিয়ে নাহি লাগে
অতীত প্রাণ যেন মন্ত্রবলে নিমেষে প্রাণে নাহি জাগে।
প্রতাপরায় তাই দেখিছে শুধু কাশীর বৃথা মাথা-নাড়া---
সুরের পরে সুর ফিরিয়া যায়, হৃদয়ে নাহি পায় সাড়া।

থামিল গান যবে ক্ষণেক-তরে বিরাম মাগে কাশীনাথ;
বরজলাল-পানে প্রতাপ রায় হাসিয়া করে আঁখিপাত।
কানের কাছে তার রাখিয়া মুখ কহিল, ``ওস্তাদজি,
গানের মতো গান শুনায়ে দাও, এরে কি গান বলে, ছি!
এ যেন পাখি লয়ে বিবিধ ছলে, শিকারী বিড়ালের খেলা।
সেকালে গান ছিল, একালে হায় গানের বড়ো অবহেলা।

বরজলাল বুড়া শুক্লকেশ, শুভ্র উষ্ণীষ শিরে,
বিনতি করি সবে সভার মাঝে আসন নিল ধীরে ধীরে।
শিরা-বাহির-করা শীর্ণ করে তুলিয়া নিল তানপুর,
ধরিল নতশিরে নয়ন মুদি ইমনকল্যাণ সুর।
কাঁপিয়া ক্ষীণ স্বর মরিয়া যায় বৃহত্‍‌ সভাগৃহকোণে,
ক্ষুদ্র পাখি যথা ঝড়ের মাঝে উড়িতে নারে প্রাণপণে।
বসিয়া বাম পাশে প্রতাপরায়, দিতেছে শত উত্‍‌সাহ---
``আহাহা, বাহা বাহা কহিছে কানে, ``গলা ছাড়িয়া গান গাহ।

সভার লোকে সবে অন্যমনা, কেহ বা কানাকানি করে।
কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে, কেহ বা চ'লে যায় ঘরে।
``ওরে রে আয় লয়ে তামাকু পান ভৃত্যে ডাকি কেহ কয়।
সঘনে পাখা নাড়ি কেহ বা বলে, ``গরম আজি অতিশয়।
করিছে আনাগোনা ব্যস্ত লোক, ক্ষণেক নাহি রহে চুপ।
নীরব ছিল সভা, ক্রমশ সেথা শব্দ ওঠে শতরূপ।

বুড়ার গান তাহে ডুবিয়া যায়, তুফান-মাঝে ক্ষীণ তরী---
কেবল দেখা যায় তানপুরায় আঙুল কাঁপে থরথরি।
হৃদয়ে যেথা হতে গানের সুর উছসি উঠে নিজসুখে
হেলার কলরব শিলার মতো চাপে সে উত্‍‌সের মুখে---
কোথায় গান আর কোথায় প্রাণ দু দিকে ধায় দুই জনে,
তবুও রাখিবারে প্রভুর মান বরজ গায় প্রাণপণে।

গানের এক পদ মনের ভ্রমে হারায়ে গেল কী করিয়া,
আবার তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গাহে--- লইতে চাহে শুধরিয়া।
আবার ভুলে যায় পড়ে না মনে, শরমে মস্তক নাড়ি
আবার শুরু হতে ধরিল গান--- আবার ভুলি দিল ছাড়ি।
দ্বিগুণ থরথরি কাঁপিছে হাত, স্মরণ করে গুরুদেবে।
কণ্ঠ কাঁপিতেছে কাতরে, যেন বাতাসে দীপ নেবে-নেবে।
গানের পদ তবে ছাড়িয়া দিয়া রাখিল সুরটুকু ধরি,
সহসা হাহারবে উঠিল কাঁদি গাহিতে গিয়া হা-হা করি।
কোথায় দূরে গেল সুরের খেলা, কোথায় তাল গেল ভাসি,
গানের সুতা ছিঁড়ি পড়িল খসি, অশ্রু-মুকুতার রাশি।
কোলের সখী তানপুরার 'পরে রাখিল লজ্জিত মাথা---
ভুলিল শেখা গান, পড়িল মনে বাল্যক্রন্দনগাথা।
নয়ন ছলছল, প্রতাপরায় কর বুলায় তার দেহে---
``আইস হেথা হতে আমরা যাই কহিল সকরুণ স্নেহে।
শতেক-দীপ-জ্বালা নয়ন-ভরা ছাড়ি সে উত্‍‌সবঘর
বাহিরে গেল দুটি প্রাচীন সখা ধরিয়া দুঁহু দোঁহা-কর।

বরজ করজোড়ে কহিল, ``প্রভু, মোদের সভা হল ভঙ্গ।
এখন আসিয়াছে নূতন লোক, ধরায় নব নব রঙ্গ!
জগতে আমাদের বিজন সভা কেবল তুমি আর আমি---
সেথায় আনিয়ো না নূতন শ্রোতা, মিনতি তব পদে স্বামী!
একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুই জনে---
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেক জন গাবে মনে।
তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ তবে সে কলতান উঠে---
বাতাসে বনসভা শিহরি কাঁপে, তবে সে মর্মর ফুটে।
জগতে যেথা যত রয়েছে ধ্বনি যুগল মিলিয়াছে আগে---
যেখানে প্রেম নাই, বোবার সভা, সেখানে গান নাহি জাগে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা



 #106

গানের খেয়া 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


যে গান আমি গাই
জানি নে সে
কার উদ্দেশ্যে।
যবে জাগে মনে
অকারণে
চপল হাওয়া
সুর যায় ভেসে
কার উদ্দেশ্যে।
ঐ মুখে চেয়ে দেখি,
জানি নে তুমিই সে কি
অতীত কালের মুরতি এসেছ
নতুন কালের বেশে।
কভূ জাগে মনে,
যে আসে নি এ জীবনে
ঘাট খুঁজি খুঁজি
গানের খেয়া সে মাগিতেছে বুঝি
আমার তীরেতে এসে।






 #107

গানের জাল 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


দেবে তুমি
কখন নেশায় পেয়ে
আপন-মনে
যাও চলে গান গেয়ে।
যে আকাশের সুরের লেখা লেখ
কুঝি না তা, কেবল রহি চেয়ে।
হৃদয় আমার অদৃশ্যে যায় চলে,
প্রতিদিনের ঠিকঠিকানা ভোলে-
মৌমাছিরা আপনা হারায় যেন
গন্ধের পথ বেয়ে।

গানের টানা জালে
নিমেষ-ঘেরা বাঁধন হাতে
টানে অসীম কালে।
মাটির আড়ালে করি ভেদন
স্বর্গলোকের আনে বেদন,
পরান ফেলে ছেয়ে।





 #108

গানের পারে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ও পারে।
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।
বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরী,
এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয়-মাঝারে।।
তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে -
বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে।
কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি
আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে?।

শান্তিনিকেতন
২৮ ফাল্গুন ১৩২০


(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)






 #109

গান্ধারীর আবেদন 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


দুর্যোধন। প্রণমি চরণে তাত!

ধৃতরাষ্ট্র। ওরে দুরাশয়,
অভীষ্ট হয়েছে সিদ্ধ?

দুর্যোধন। লভিয়াছি জয়।

ধৃতরাষ্ট্র। এখন হয়েছ সুখী?

দুর্যোধন। হয়েছি বিজয়ী।

ধৃতরাষ্ট্র। অখণ্ড রাজত্ব জিনি সুখ তোর কই
রে দুর্মতি?

দুর্যোধন। সুখ চাহি নাই মহারাজ!
জয়, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।
ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা
কুরুপতি-- দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা
জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,
সদ্য করিয়াছি পান; সুখী নহি, তাত,
অদ্য আমি জয়ী। পিতঃ, সুখে ছিনু, যবে
একত্রে আছিনু বদ্ধ পাণ্ডবে কৌরবে,
কলঙ্ক যেমন থাকে শশাঙ্কের বুকে
কর্মহীন গর্বহীন দীপ্তিহীন সুখে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবের গাণ্ডীবটঙ্কারে
শঙ্কাকুল শত্রুদল আসিত না দ্বারে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবেরা জয়দৃপ্ত করে
ধরিত্রী দোহন করি' ভ্রাতৃপ্রীতিভরে
দিত অংশ তার-- নিত্য নব ভোগসুখে
আছিনু নিশ্চিন্তচিত্তে অনন্ত কৌতুকে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবের জয়ধ্বনি যবে
হানিত কৌরবকর্ণ প্রতিধ্বনিরবে।
পাণ্ডবের যশোবিম্ব-প্রতিবিম্ব আসি
উজ্জ্বল অঙ্গুলি দিয়া দিত পরকাশি
মলিন কৌরবকক্ষ। সুখে ছিনু, পিতঃ,
আপনার সর্বতেজ করি নির্বাপিত
পাণ্ডবগৌরবতলে স্নিগ্ধশান্তরূপে,
হেমন্তের ভেক যথা জড়ত্বের কূপে।
আজি পাণ্ডুপুত্রগণে পরাভব বহি
বনে যায় চলি-- আজ আমি সুখী নহি,
আজ আমি জয়ী।

ধৃতরাষ্ট্র। ধিক্‌ তোর ভ্রাতৃদ্রোহ।
পাণ্ডবের কৌরবের এক পিতামহ
সে কি ভুলে গেলি?

দুর্যোধন। ভুলিতে পারি নে সে যে--
এক পিতামহ, তবু ধনে মানে তেজে
এক নহি। যদি হত দূরবর্তী পর
নাহি ছিল ক্ষোভ; শর্বরীর শশধর
মধ্যাহ্নের তপনেরে দ্বেষ নাহি করে,
কিন্তু প্রাতে এক পূর্ব-উদয়শিখরে
দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক কিছুতে না ধরে।
আজ দ্বন্দ্ব ঘুচিয়াছে, আজি আমি জয়ী,
আজি আমি একা।

ধৃতরাষ্ট্র। ক্ষুদ্র ঈর্ষা! বিষময়ী
ভুজঙ্গিনী!

দুর্যোধন। ক্ষুদ্র নহে, ঈর্ষা সুমহতী।
ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম। দুই বনস্পতি
মধ্যে রাখে ব্যবধান; লক্ষ লক্ষ তৃণ
একত্রে মিলিয়া থাকে বক্ষে বক্ষে লীন;
নক্ষত্র অসংখ্য থাকে সৌভ্রাত্রবন্ধনে--
এক সূর্য, এক শশী। মলিন কিরণে
দূর বন-অন্তরালে পাণ্ডুচন্দ্রলেখা
আজি অস্ত গেল, আজি কুরুসূর্য একা--
আজি আমি জয়ী!

ধৃতরাষ্ট্র। আজি ধর্ম পরাজিত।

দুর্যোধন। লোকধর্ম রাজধর্ম এক নহে পিতঃ!
লোকসমাজের মাঝে সমকক্ষ জন
সহায় সুহৃদ্‌-রূপে নির্ভর বন্ধন।
কিন্তু রাজা একেশ্বর; সমকক্ষ তার
মহাশত্রু, চিরবিঘ্ন, স্থান দুশ্চিন্তার,
সম্মুখের অন্তরাল, পশ্চাতের ভয়,
অহর্নিশি যশঃশক্তিগৌরবের ক্ষয়,
ঐশ্বর্যের অংশ-অপহারী। ক্ষুদ্র জনে
বলভাগ ক'রে লয়ে বান্ধবের সনে
রহে বলী; রাজদণ্ড যত খণ্ড হয়
তত তার দুর্বলতা, তত তার ক্ষয়।
একা সকলের ঊর্ধ্বে মস্তক আপন
যদি না রাখিবে রাজা, যদি বহুজন
বহুদূর হতে তাঁর সমুদ্ধত শির
নিত্য না দেখিতে পায় অব্যাহত স্থির,
তবে বহুজন--'পরে বহুদূরে তাঁর
কেমনে শাসনদৃষ্টি রহিবে প্রচার?
রাজধর্মে ভ্রাতৃধর্ম বন্ধুধর্ম নাই,
শুধু জয়ধর্ম আছে, মহারাজ, তাই
আজি আমি চরিতার্থ-- আজি জয়ী আমি--
সম্মুখের ব্যবধান গেছে আজি নামি
পাণ্ডবগৌরবগিরি পঞ্চচূড়াময়।

ধৃতরাষ্ট্র। জিনিয়া কপটদ্যূতে তারে কোস জয়,
লজ্জাহীন অহংকারী!

দুর্যোধন। যার যাহা বল
তাই তার অস্ত্র, পিতঃ, যুদ্ধের সম্বল।
ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান,
তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ
কোন্‌ নর লজ্জা পায়? মূঢ়ের মতন
ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুমাঝে আত্মসমর্পণ
যুদ্ধ নহে, জয়লাভ এক লক্ষ্য তার--
আজি আমি জয়ী পিতঃ, তাই অহংকার।

ধৃতরাষ্ট্র। আজি তুমি জয়ী, তাই তব নিন্দাধ্বনি
পরিপুর্ণ করিয়াছে অম্বর অবনী
সমুচ্চ ধিক্কারে।

দুর্যোধন। নিন্দা! আর নাহি ডরি,
নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি।
নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী
স্পর্ধিত রসনা তার দৃঢ়বলে চাপি
মোর পাদপীঠতলে। 'দুর্যোধন পাপী'
'দুর্যোধন ক্রূরমনা' 'দুর্যোধন হীন'
নিরুত্তরে শুনিয়া এসেছি এতদিন,
রাজদণ্ড স্পর্শ করি কহি মহারাজ,
আপামর জনে আমি কহাইব আজ--
'দুর্যোধন রাজা, দুর্যোধন নাহি সহে
রাজনিন্দা-আলোচনা, দুর্যোধন বহে
নিজ হস্তে নিজ নাম।'

ধৃতরাষ্ট্র। ওরে বৎস, শোন্‌,
নিন্দারে রসনা হতে দিলে নির্বাসন
নিম্নমুখে অন্তরের গূঢ় অন্ধকারে
গভীর জটিল মূল সুদূরে প্রসারে,
নিত্য বিষতিক্ত করি রাখে চিত্ততল।
রসনায় নৃত্য করি চপল চঞ্চল
নিন্দা শ্রান্ত হয়ে পড়ে; দিয়ো না তাহারে
নিঃশব্দে আপন শক্তি বৃদ্ধি করিবারে
গোপন হৃদয়দুর্গে। প্রীতিমন্ত্রবলে
শান্ত করো, বন্দী করো নিন্দাসর্পদলে
বংশীরবে হাস্যমুখে।

দুর্যোধন। অব্যক্ত নিন্দায়
কোনো ক্ষতি নাহি করে রাজমর্যাদায়;
ভ্রূক্ষেপ না করি তাহে। প্রীতি নাহি পাই
তাহে খেদ নাহি, কিন্তু স্পর্ধা নাহি চাই
মহারাজ! প্রীতিদান স্বেচ্ছার অধীন,
প্রীতিভিক্ষা দিয়ে থাকে দীনতম দীন--
সে প্রীতি বিলাক তারা পালিত মার্জারে,
দ্বারের কুক্কুরে, আর পাণ্ডবভ্রাতারে--
তাহে মোর নাহি কাজ। আমি চাহি ভয়,
সেই মোর রাজপ্রাপ্য-- আমি চাহি জয়
দর্পিতের দর্প নাশি। শুন নিবেদন
পিতৃদেব-- একাল তব সিংহাসন
আমার নিন্দুকদল নিত্য ছিল ঘিরে,
কণ্টকতরুর মতো নিষ্ঠুর প্রাচীরে
তোমার আমার মধ্যে রচি ব্যবধান--
শুনায়েছে পাণ্ডবের নিত্যগুণগান,
আমাদের নিত্য নিন্দা-- এইমতে, পিতঃ,
পিতৃস্নেহ হতে মোরা চিরনির্বাসিত।
এইমতে, পিতঃ, মোরা শিশুকাল হতে
হীনবল-- উৎসমুখে পিতৃস্নেহস্রোতে
পাষাণের বাধা পড়ি মোরা পরিক্ষীণ
শীর্ণ নদ, নষ্টপ্রাণ, গতিশক্তিহীন,
পদে পদে প্রতিহত; পাণ্ডবেরা স্ফীত,
অখণ্ড, অবাধগতি। অদ্য হতে পিতঃ,
যদি সে নিন্দুকদলে নাহি কর দূর
সিংহাসনপার্শ্ব হতে, সঞ্জয় বিদুর
ভীষ্মপিতামহে, যদি তারা বিজ্ঞবেশে
হিতকথা ধর্মকথা সাধু-উপদেশে
নিন্দায় ধিক্কারে তর্কে নিমেষে নিমেষে
ছিন্ন ছিন্ন করি দেয় রাজকর্মডোর,
ভারাক্রান্ত করি রাখে রাজদণ্ড মোর,
পদে পদে দ্বিধা আনে রাজশক্তি-মাঝে,
মুকুট মলিন করে অপমানে লাজে,
তবে ক্ষমা দাও পিতৃদেব-- নাহি কাজ
সিংহাসনকণ্টকশয়নে-- মহারাজ,
বিনিময় করে লই পাণ্ডবের সনে
রাজ্য দিয়ে বনবাস, যাই নির্বাসনে।

ধৃতরাষ্ট্র। হায় বৎস অভিমানী! পিতৃস্নেহ মোর
কিছু যদি হ্রাস হত শুনি সুকঠোর
সুহৃদের নিন্দাবাক্য, হইত কল্যাণ।
অধর্মে দিয়েছি যোগ, হারায়েছি জ্ঞান,
এত স্নেহ। করিতেছি সর্বনাশ তোর,
এত স্নেহ। জ্বালাতেছি কালানল ঘোর
পুরাতন কুরুবংশ-মহারণ্যতলে--
তবু পুত্র, দোষ দিস স্নেহ নাই ব'লে?
মণিলোভে কালসর্প করিলি কামনা,
দিনু তোরে নিজহস্তে ধরি তার ফণা
অন্ধ আমি।-- অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে
চিরদিন-- তোরে লয়ে প্রলয়তিমিরে
চলিয়াছি-- বন্ধুগণ হাহাকাররবে
করিছে নিষেধ, নিশাচর গৃধ্র-সবে
করিতেছে অশুভ চীৎকার, পদে পদে
সংকীর্ণ হতেছে পথ, আসন্ন বিপদে
কণ্টকিত কলেবর, তবু দৃঢ়করে
ভয়ংকর স্নেহে বক্ষে বাঁধি লয়ে তোরে
বায়ুবলে অন্ধবেগে বিনাশের গ্রাসে
ছুটিয়া চলেছি মূঢ় মত্ত অট্টহাসে
উল্কার আলোকে-- শুধু তুমি আর আমি,
আর সঙ্গী বজ্রহস্ত দীপ্ত অন্তর্যামী--
নাই সম্মুখের দৃষ্টি, নাই নিবারণ
পশ্চাতের, শুধু নিম্নে ঘোর আকর্ষণ
নিদারুণ নিপাতের। সহসা একদা
চকিতে চেতনা হবে, বিধাতার গদা
মুহূর্তে পড়িবে শিরে, আসিবে সময়--
ততক্ষণ পিতৃস্নেহে কোরো না সংশয়,
আলিঙ্গন করো না শিথিল, ততক্ষণ
দ্রুত হস্তে লুটি লও সর্ব স্বার্থধন--
হও জয়ী, হও সুখী, হও তুমি রাজা
একেশ্বর।-- ওরে, তোরা জয়বাদ্য বাজা।
জয়ধ্বজা তোল্‌ শূন্যে। আজি জয়োৎসবে
ন্যায় ধর্ম বন্ধু ভ্রাতা কেহ নাহি রবে--
না রবে বিদুর ভীষ্ম, না রবে সঞ্জয়,
নাহি রবে লোকনিন্দা লোকলজ্জা-ভয়
কুরুবংশরাজলক্ষ্ণী নাহি রবে আর--
শুধু রবে অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার,
আর কালান্তক যম-- শুধু পিতৃস্নেহ
আর বিধাতার শাপ, আর নহে কেহ।


চর। মহারাজ, অগ্নিহোত্র দেব-উপাসনা
ত্যাগ করি বিপ্রগণ, ছাড়ি সন্ধ্যার্চনা,
দাঁড়ায়েছে চতুষ্পথে পাণ্ডবের তরে
প্রতীক্ষিয়া; পৌরগণ কেহ নাহি ঘরে,
পাণ্যশালা রুদ্ধ সব; সন্ধ্যা হল, তবু
ভৈরবমন্দির-মাঝে নাহি বাজে, প্রভু,
শঙ্খঘণ্টা সন্ধ্যাভেরী, দীপ নাহি জ্বলে;
শোকাতুর নরনারী সবে দলে দলে
চলিয়াছে নগরের সিংহদ্বার-পানে
দীনবেশে সজলনয়নে।

দুর্যোধন। নাহি জানে
জাগিয়াছে দুর্যোধন। মূঢ় ভাগ্যহীন!
ঘনায়ে এসেছে আজি তোদের দুর্দিন।
রাজায় প্রজায় আজি হবে পরিচয়
ঘনিষ্ঠ কঠিন। দেখি কতদিন রয়
প্রজার পরম স্পর্ধা-- নির্বিষ সর্পের
ব্যর্থ ফণা-আস্ফালন, নিরস্ত্র দর্পের
হুহুংকার।


[প্রতিহারীর প্রবেশ]

প্রতিহারী। মহারাজ, মহিষী গান্ধারী
দর্শনপ্রার্থিনী পদে।

ধৃতরাষ্ট্র। রহিনু তাঁহারি
প্রতীক্ষায়।

দুর্যোধন। পিতঃ, আমি চলিলাম তবে।

ধৃতরাষ্ট্র। করো পলায়ন। হায়, কেমনে বা সবে
সাধ্বী জননীর দৃষ্টি সমুদ্যত বাজ
ওরে পুণ্যভীত! মোরে তোর নাহি লাজ।


[গান্ধারীর প্রবেশ]

গান্ধারী। নিবেদন আছে শ্রীচরণে। অনুনয়
রক্ষা করো নাথ!

ধৃতরাষ্ট্র। কভু কি অপূর্ণ রয়
প্রিয়ার প্রার্থনা?

গান্ধারী। ত্যাগ করো এইবার--

ধৃতরাষ্ট্র। কারে হে মহিষী?

গান্ধারী। পাপের সংঘর্ষে যার
পড়িছে ভীষণ শান ধর্মের কৃপাণে,
সেই মূঢ়ে।

ধৃতরাষ্ট্র। কে সে জন? আছে কোন্‌খানে?
শুধু কহো নাম তার।

গান্ধারী। পুত্র দুর্যোধন।

ধৃতরাষ্ট্র। তাহারে করিব ত্যাগ!

গান্ধারী। এই নিবেদন
তব পদে।

ধৃতরাষ্ট্র। দারুণ প্রার্থনা, হে গান্ধারী
রাজমাতা!

গান্ধারী। এ প্রার্থনা শুধু কি আমারি
হে কৌরব? কুরুকুলপিতৃপিতামহ
স্বর্গ হতে এ প্রার্থনা করে অহরহ
নরনাথ! ত্যাগ করো, ত্যাগ করো তারে--
কৌরবকল্যাণলক্ষ্ণী যার অত্যাচারে
অশ্রুমুখী প্রতীক্ষিছে বিদায়ের ক্ষণ
রাত্রিদিন।

ধৃতরাষ্ট্র। ধর্ম তারে করিবে শাসন
ধর্মেরে যে লঙ্ঘন করেছে-- আমি পিতা--

গান্ধারী। মাতা আমি নহি? গর্ভভারজর্জরিতা
জাগ্রহ হৃৎপিণ্ডতলে বহি নাই তারে?
স্নেহবিগলিত চিত্ত শুভ্র দুগ্ধধারে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে নাই দুই স্তন বাহি
তার সেই অকলঙ্ক শিশুমুখ চাহি?
শাখাবন্ধে ফল যথা সেইমত করি
বহু বর্ষ ছিল না সে আমারে আঁকড়ি
দুই ক্ষুদ্র বহুবৃন্ত দিয়ে-- লয়ে টানি
মোর হাসি হতে হাসি, বাণী হতে বাণী,
প্রাণ হতে প্রাণ? তবু কহি, মহারাজ,
সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করো আজ।

ধৃতরাষ্ট্র। কী রাখিব তারে ত্যাগ করি?

গান্ধারী। ধর্ম তব।

ধৃতরাষ্ট্র। কী দিবে তোমারে ধর্ম?

গান্ধারী। দুঃখ নব নব।
পুত্রসুখ রাজ্যসুখ অধর্মের পণে
জিনি লয়ে চিরদিন বহিব কেমনে
দুই কাঁটা বক্ষে আলিঙ্গিয়া?

ধৃতরাষ্ট্র। হায় প্রিয়ে,
ধর্মবশে একবার দিনু ফিরাইয়ে
দ্যূতবদ্ধ পাণ্ডবের হৃত রাজ্যধন।
পরক্ষণে পিতৃস্নেহ করিল গুঞ্জন
শত বার কর্ণে মোর, 'কী করিলি ওরে!
এক কালে ধর্মাধর্ম দুই তরী-'পরে
পা দিয়ে বাঁচে না কেহ। বারেক যখন
নেমেছে পাপের স্রোতে কুরুপুত্রগণ
তখন ধর্মের সাথে সন্ধি করা মিছে;
পাপের দুয়ারে পাপ সহায় মাগিছে।
কী করিলি হতভাগ্য, বৃদ্ধ বুদ্ধিহত,
দুর্বল দ্বিধায় পড়ি? অপমানক্ষত
রাজ্য ফিরে দিলে তবু মিলাবে না আর
পাণ্ডবের মনে-- শুধু নব কাষ্ঠভার
হুতাশনে দান। অপমানিতের করে
ক্ষমতার অস্ত্র দেওয়া মরিবার তরে।
সক্ষমে দিয়ো না ছাড়ি দিয়ে স্বল্প পীড়া--
করহ দলন। কোরো না বিফল ক্রীড়া
পাপের সহিত; যদি ডেকে আন তারে,
বরণ করিয়া তবে লহো একেবারে।'
এইমত পাপবুদ্ধি পিতৃস্নেহরূপে
বিঁধিতে লাগিল মোর কর্ণে চুপে চুপে
কত কথা তীক্ষ্ণ সূচিসম। পুনরায়
ফিরানু পাণ্ডবগণে; দ্যূতছলনায়
বিসর্জিনু দীর্ঘ বনবাসে। হায় ধর্ম,
হায় রে প্রবৃত্তিবেগ! কে বুঝিবে মর্ম
সংসারের!

গান্ধারী। ধর্ম নহে সম্পদের হেতু,
মহারাজ, নহে সে সুখের ক্ষুদ্র সেতু--
ধর্মেই ধর্মের শেষ। মূঢ়-নারী আমি,
ধর্মকথা তোমারে কী বুঝাইব স্বামী,
জান তো সকলই। পাণ্ডবেরা যাবে বনে,
ফিরাইলে ফিরিবে না, বদ্ধ তারা পণে।
এখন এ মহারাজ্য একাকী তোমার
মহীপতি-- পুত্রে তব ত্যজ এইবার;
নিষ্পাপেরে দুঃখ দিয়ে নিজে পুর্ণ সুখ
লইয়ো না, ন্যায়ধর্মে কোরো না বিমুখ
পৌরবপ্রাসাদ হতে-- দুঃখ সুদুঃসহ
আজ হতে, ধর্মরাজ, লহো তুলি লহো,
দেহো তুলি মোর শিরে।

ধৃতরাষ্ট্র। হায় মহারানী,
সত্য তব উপদেশ, তীব্র তব বাণী।

গান্ধারী। অধর্মের মধুমাখা বিষফল তুলি
আনন্দে নাচিছে পুত্র; স্নেহমোহে ভুলি
সে ফল দিয়ো না তারে ভোগ করিবারে;
কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।
ছললব্ধ পাপস্ফীত রাজ্যধনজনে
ফেলে রাখি সেও চলে যাক নির্বাসনে,
বঞ্চিত পাণ্ডবদের সমদুঃখভার
করুক বহন।

ধৃতরাষ্ট্র। ধর্মবিধি বিধাতার--
জাগ্রত আছেন তিনি, ধর্মদণ্ড তাঁর
রয়েছে উদ্যত নিত্য; অয়ি মনস্বিনী,
তাঁর রাজ্যে তাঁর কার্য করিবেন তিনি।
আমি পিতা--

গান্ধারী। তুমি রাজা, রাজ-অধিরাজ,
বিধাতার বাম হস্ত; ধর্মরক্ষা-কাজ
তোমা-'পরে সমর্পিত। শুধাই তোমারে,
যদি কোনো প্রজা তব সতী অবলারে
পরগৃহ হতে টানি করে অপমান
বিনা দোষে-- কী তাহার করিবে বিধান?

ধৃতরাষ্ট্র। নির্বাসন।

গান্ধারী। তবে আজ রাজপদতলে
সমস্ত নারীর হয়ে নয়নের জলে
বিচার প্রার্থনা করি। পুত্র দুর্যোধন
অপরাধী প্রভু! তুমি আছ, হে রাজন,
প্রমাণ আপনি। পুরুষে পুরুষে দ্বন্দ্ব
স্বার্থ লয়ে বাধে অহরহ-- ভালোমন্দ
নাহি বুঝি তার; দণ্ডনীতি, ভেদনীতি,
কূটনীতি কত শত, পুরুষের রীতি
পুরুষেই জানে। বলের বিরোধে বল,
ছলের বিরোধে কত জেগে উঠে ছল,
কৌশলে কৌশল হানে-- মোরা থাকি দূরে
আপনার গৃহকর্মে শান্ত অন্তঃপুরে
যে সেথা টানিয়া আনে বিদ্বেষ-অনল,
যে সেথা সঞ্চার করে ঈর্ষার গরল
বাহিরের দ্বন্দ্ব হতে, পুরুষেরে ছাড়ি
অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া নিরুপায় নারী
গৃহধর্মচারিণীর পুণ্যদেহ- 'পরে
কলুষপরুষ স্পর্শে অসম্মানে করে
হস্তক্ষেপ-- পতি-সাথে বাধায়ে বিরোধ
যে নর পত্নীরে হানি লয় তার শোধ,
সে শুধু পাষণ্ড নহে, সে যে কাপুরুষ।
মহারাজ, কী তার বিধান? অকলুষ
পুরুবংশে পাপ যদি জন্মলাভ করে
সেও সহে; কিন্তু, প্রভু, মাতৃগর্বভরে
ভেবেছিনু গর্ভে মোর বীরপুত্রগণ
জন্মিয়াছে-- হায় নাথ, সেদিন যখন
অনাথিনী পাঞ্চালীর আর্তকণ্ঠরব
প্রাসাদপাষাণভিত্তি করি দিল দ্রব
লজ্জা-ঘৃণা-করুণার তাপে, ছুটি গিয়া
হেরিনু গবাক্ষে, তার বস্ত্র আকর্ষিয়া
খল খল হাসিতেছে সভা-মাঝখানে
গান্ধারীর পুত্র পিশাচেরা-- ধর্ম জানে
সেদিন চূর্ণিয়া গেল জন্মের মতন
জননীর শেষ গর্ব। কুরুরাজগণ,
পৌরুষ কোথায় গেছে ছাড়িয়া ভারত!
তোমরা, হে মহারথী, জড়মূর্তিবৎ
বসিয়া রহিলে সেথা চাহি মুখে মুখে,
কেহ বা হাসিলে, কেহ করিলে কৌতুকে
কানাকানি-- কোষমাঝে নিশ্চল কৃপাণ
বজ্রনিঃশেষিত লুপ্তবিদ্যুৎ-সমান
নিদ্রাগত-- মহারাজ, শুন মহারাজ,
এ মিনতি। দূর করো জননীর লাজ,
বীরধর্ম করহ উদ্ধার, পদাহত
সতীত্বের ঘুচাও ক্রন্দন; অবনত
ন্যায়ধর্মে করহ সম্মান-- ত্যাগ করো
দূর্যোধনে।

ধৃতরাষ্ট্র। পরিতাপদহনে জর্জর
হৃদয়ে করিছ শুধু নিষ্ফল আঘাত
হে মহিষী!

গান্ধারী। শতগুণ বেদনা কি, নাথ,
লাগিছে না মোরে? প্রভু, দণ্ডিতের সাথে
দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। যার তারে প্রাণ
কোনো ব্যথা নাহি পায় তার দণ্ডদান
প্রবলের অত্যাচার। যে দণ্ডবেদনা
পুত্রেরে পার না দিতে সে কারে দিয়ো না;
যে তোমার পুত্র নহে তারো পিতা আছে,
মহা-অপরাধী হবে তুমি তার কাছে
বিচারক। শুনিয়াছি বিশ্ববিধাতার
সবাই সন্তান মোরা-- পুত্রের বিচার
নিয়ত করেন তিনি আপনার হাতে
নারায়ণ; ব্যথা দেন, ব্যথা পান সাথে;
নতুবা বিচারে তাঁর নাই অধিকার,
মূঢ় নারী লভিয়াছি অন্তরে আমার
এই শাস্ত্র। পাপী পুত্রে ক্ষমা কর যদি
নির্বিচারে, মহারাজ, তবে নিরবধি
যত দণ্ড দিলে তুমি যত দোষীজনে,
ধর্মাধিপ নামে, কর্তব্যের প্রবর্তনে,
ফিরিয়া লাগিবে আসি দণ্ডদাতা ভূপে--
ন্যায়ের বিচার তব নির্মমতারূপে
পাপ হয়ে তোমারে দাগিবে। ত্যাগ করো
পাপী দুর্যোধনে।

ধৃতরাষ্ট্র। প্রিয়ে, সংহর, সংহর
তব বাণী। ছিঁড়িতে পারি নে মোহডোর,
ধর্মকথা শুধু আসি হানে সুকঠোর
ব্যর্থ ব্যথা। পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার,
তাই তারে ত্যজিতে না পারি-- আমি তার
একমাত্র। উন্মত্ত-তরঙ্গ-মাঝখানে
যে পুত্র সঁপেছে অঙ্গ তারে কোন্‌ প্রাণে
ছাড়ি যাব? উদ্ধারের আশা ত্যাগ করি
তবু তারে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরি,
তারি সাথে এক পাপে ঝাঁপ দিয়া পড়ি
এক বিনাশের তলে তলাইয়া মরি
অকাতরে-- অংশ লই তার দুর্গতির,
অর্ধ ফল ভোগ করি তার দুর্মতির,
সেই তো সান্ত্বনা মোর-- এখন তো আর
বিচারের কাল নাই, নাই প্রতিকার,
নাই পথ-- ঘটেছে যা ছিল ঘটিবার,
ফলিবে যা ফলিবার আছে।

[প্রস্থান]

গান্ধারী। হে আমার
অশান্ত হৃদয়, স্থির হও। নতশিরে
প্রতীক্ষা করিয়া থাকো বিধির বিধিরে
ধৈর্য ধরি। যেদিন সুদীর্ঘ রাত্রি-'পরে
সদ্য জেগে উঠে কাল সংশোধন করে
আপনারে, সেদিন দারুণ দুঃখদিন।
দুঃসহ উত্তাপে যথা স্থির গতিহীন
ঘুমাইয়া পড়ে বায়ু-- জাগে ঝঞ্ঝাঝড়ে
অকস্মাৎ, আপনার জড়ত্বের 'পরে
করে আক্রমণ, অন্ধ বৃশ্চিকের মতো
ভীমপুচ্ছে আত্মশিরে হানে অবিরত
দীপ্ত বজ্রশূল, সেইমত কাল যবে
জাগে, তারে সভয়ে অকাল কহে সবে।
লুটাও লুটাও শির-- প্রণম, রমণী,
সেই মহাকালে; তার রথচক্রধ্বনি
দূর রুদ্রলোক হতে বজ্রঘর্ঘরিত
ওই শুনা যায়। তোর আর্ত জর্জরিত
হৃদয় পাতিয়া রাখ্‌ তার পথতলে।
ছিন্ন সিক্ত হৃৎপিণ্ডের রক্তশতদলে
অঞ্জলি রচিয়া থাক্‌ জাগিয়া নীরবে
চাহিয়া নিমেষহীন। তার পরে যবে
গগনে উড়িবে ধূলি, কাঁপিবে ধরণী,
সহসা উঠিবে শূন্যে ক্রন্দনের ধ্বনি--
হায় হায় হা রমণী, হায় রে অনাথা,
হায় হায় বীরবধূ; হায় বীরমাতা,
হায় হায় হাহাকার-- তখন সুধীরে
ধুলায় পড়িস লুটি অবনতশিরে
মুদিয়া নয়ন। তার পরে নমো নম
সুনিশ্চিত পরিণাম, নির্বাক্‌ নির্মম
দারুণ করুণ শান্তি! নমো নমো নম
কল্যাণ কঠোর কান্ত, ক্ষমা স্নিগ্ধতম!
নমো নমো বিদ্বেষের ভীষণা নির্বৃতি!
শ্মশানে ভস্মমাখা পরমা নিষ্কৃতি!


[দুর্যোধন-মহিষী ভানুমতীর প্রবেশ]

ভানুমতী। ইন্দুমুখী, পরভৃতে, লহো তুলি শিরে
মাল্যবস্ত্র অলংকার।

গান্ধারী। বৎসে, ধীরে, ধীরে।
পৌরব ভবনে কোন্‌ মহোৎসব আজি?
কোথা যাও নব বস্ত্র-অলংকারে সাজি
বধূ মোর?

ভানুমতী। শত্রুপরাভব-শুভক্ষণ
সমাগত।

গান্ধারী। শত্রু যার আত্মীয়স্বজন
আত্মা তার নিত্য শত্রু, ধর্ম শত্রু তার,
অজেয় তাহার শত্রু। নব অলংকার
কোথা হতে হে কল্যাণী?

ভানুমতী। জিনি বসুমতী
ভুজবলে, পাঞ্চালীরে তার পঞ্চপতি
দিয়েছিল যত রত্নমণি-অলংকার--
যজ্ঞদিনে যাহা পরি ভাগ্য-অহংকার
ঠিকরিত মাণিক্যের শত সূচীমুখে
দ্রৌপদীর অঙ্গ হতে, বিদ্ধ হত বুকে
কুরুকুলকামিনীর, সে রত্নভূষণে
আমারে সাজায়ে তারে যেতে হল বনে।

গান্ধারী। হা রে মূঢ়ে, শিক্ষা তবু হল না তোমার--
সেই রত্ন নিয়ে তবু এত অহংকার!
এ কী ভয়ংকরী কান্তি, প্রলয়ের সাজ।
যুগান্তের উল্কাসম দহিছে না আজ
এ মণিমঞ্জীর তোরে? রত্নললাটিকা
এ যে তোর সৌভাগ্যের বজ্রানলশিখা।
তোরে হেরি অঙ্গে মোর ত্রাসের স্পন্দন
সঞ্চারিছে, চিত্তে মোর উঠিছে ক্রন্দন--
আনিছে শঙ্কিত কর্ণে তোর অলংকার
উন্মাদিনী শংকরীর তাণ্ডবঝংকার।

ভানুমতী। মাতঃ, মোরা ক্ষত্রনারী, দুর্ভাগ্যের ভয়
নাহি করি। কভু জয়, কভু পরাজয়--
মধ্যাহ্নগগনে কভু, কভু অস্তধামে,
ক্ষত্রিয়মহিমা-সূর্য উঠে আর নামে।
ক্ষত্রবীরাঙ্গনা, মাতঃ, সেই কথা স্মরি
শঙ্কার বক্ষেতে থাকি সংকটে না ডরি
ক্ষণকাল। দুর্দিন দুর্যোগ যদি আসে,
বিমুখ ভাগ্যেরে তবে হানি উপহাসে
কেমনে মরিতে হয় জানি তাহা দেবী--
কেমনে বাঁচিতে হয় শ্রীচরণ সেবি
সে শিক্ষাও লভিয়াছি।

গান্ধারী। বৎসে, অমঙ্গল
একেলা তোমার নহে। লয়ে দলবল
সে যবে মিটায় ক্ষুধা, উঠে হাহাকার,
কত বীররক্তস্রোতে কত বিধবার
অশ্রুধারা পড়ে আসি-- রত্ন-অলংকার
বধূহস্ত হতে খসি পড়ে শত শত
চূতলতাকুঞ্জবনে মঞ্জরীর মতো
ঝঞ্ঝাবাতে। বৎসে, ভাঙিয়ো না বদ্ধ সেতু,
ক্রীড়াচ্ছলে তুলিয়ো না বিপ্লবের কেতু
গৃহমাঝে-- আনন্দের দিন নহে আজি।
স্বজনদুর্ভাগ্য লয়ে সর্ব অঙ্গে সাজি
গর্ব করিয়ো না মাতঃ! হয়ে সুসংযত
আজ হতে শুদ্ধচিত্তে উপবাসব্রত
করো আচরণ-- বেণী করি উন্মোচন
শান্ত মনে করো, বৎসে, দেবতা-অর্চন।
এ পাপসৌভাগ্যদিনে গর্ব-অহংকারে
প্রতিক্ষণে লজ্জা দিয়ো নাকো বিধাতারে।
খুলে ফেলো অলংকার, নব রক্তাম্বর;
থামাও উৎসববাদ্য, রাজ-আড়ম্বর;
অগ্নিগৃহে যাও, পুত্রী, ডাকো পুরোহিতে--
কালের প্রতীক্ষা করো শুদ্ধসত্ত্ব চিতে্‌।

যুধিষ্ঠির। আশীর্বাদ মাগিবারে এসেছি, জননী,
বিদায়ের কালে।


গান্ধারী। সৌভাগ্যের দিনমণি
দুঃখরাত্রি-অবসানে দ্বিগুণ উজ্জ্বল
উদিবে হে বৎসগণ! বায়ু হতে বল,
সূর্য হতে তেজ, পৃথ# হতে ধৈর্যক্ষমা
করো লাভ দুঃখব্রত পুত্র মোর! রমা
দৈন্য-মাঝে গুপ্ত থাকি দীন-ছদ্ম-রূপে
ফিরুন পশ্চাতে তব সদা চুপে চুপে,
দুঃখ হতে তোমা-তরে করুন সঞ্চয়
অক্ষয় সম্পদ। নিত্য হউক নির্ভয়
নির্বাসনবাস। বিনা পাপে দুঃখভোগ
অন্তরে জ্বলন্ত তেজ করুক সংযোগ
বহ্নিশিখাদগ্ধ দীপ্ত সুবর্ণের প্রায়।
সেই মহাদুঃখ হবে মহৎ সহায়
তোমাদের। সেই দুঃখে রহিবেন ঋণী
ধর্মরাজ বিধি, যবে শুধিবেন তিনি
নিজহস্তে আত্মঋণ তখন জগতে
দেব নর কে দাঁড়াবে তোমাদের পথে!
মোর পুত্র করিয়াছে যত অপরাধ
খণ্ডন করুক সব মোর আশীর্বাদ
পুত্রাধিক পুত্রগণ! অন্যায় পীড়ন
গভীর কল্যাণসিন্ধু করুক মন্থন।
(দ্রৌপদীকে আলিঙ্গনপূর্বক)
ভূলুণ্ঠিতা স্বর্ণলতা, হে বৎসে আমার,
হে আমার রাহুগ্রস্ত শশী, একবার
তোলো শির, বাক্য মোর করো অবধান।
যে তোমারে অবমানে তারি অপমান
জগতে রহিবে নিত্য, কলঙ্ক অক্ষয়।
তব অপমানরাশি বিশ্বজগন্ময়
ভাগ করে লইয়াছে সর্ব কুলাঙ্গনা--
কাপুরুষতার হস্তে সতীর লাঞ্ছনা।
যাও বৎসে, পতি-সাথে অমলিনমুখ
অরণ্যেরে করো স্বর্গ, দুঃখে করো সুখ।
বধূ মোর, সুদুঃসহ পতিদুঃখব্যথা
বক্ষে ধরি সতীত্বের লভো সার্থকতা।
রাজগৃহে আয়োজন দিবসযামিনী
সহস্র সুখের-- বনে তুমি একাকিনী
সর্বসুখ, সর্বসঙ্গ, সর্বৈশ্বর্যময়,
সকল সান্ত্বনা একা, সকল আশ্রয়,
ক্লান্তির আরাম, শান্তি, ব্যাধির শুশ্রূষা,
দুর্দিনের শুভলক্ষ্ণী, তামসীর ভূষা
উষা মূর্তিমতী। তুমি হবে একাকিনী
সর্বপ্রীতি, সর্বসেবা, জননী, গেহিনী--
সতীত্বের শ্বেতপদ্ম সম্পূর্ণ সৌরভে
শতদলে প্রস্ফুটিয়া জাগিবে গৌরবে।






 #110

গৃহশত্রু 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমি একাকিনী যবে চলি রাজপথে
নব অভিসারসাজে,
নিশীথে নীরব নিখিল ভুবন,
না গাহে বিহগ, না চলে পবন,
মৌন সকল পৌর ভবন
সুপ্তনগরমাঝে--
শুধু আমার নূপুর আমারি চরণে
বিমরি বিমরি বাজে।
অধীর মুখর শুনিয়া সে স্বর
পদে পদে মরি লাজে।


আমি চরণশব্দ শুনিব বলিয়া
বসি বাতায়নকাছে--
অনিমেষ তারা নিবিড় নিশায়,
লহরীর লেশ নাহি যমুনায়,
জনহীন পথ আঁধারে মিশায়,
পাতাটি কাঁপে না গাছে--
শুধু আমারি উরসে আমারি হৃদয়
উলসি বিলসি নাচে।
উতলা পাগল করে কলরোল,
বাঁধন টুটিলে বাঁচে।


আমি কুসুমশয়নে মিলাই শরমে,
মধুর মিলনরাতি--
স্তব্ধ যামিনী ঢাকে চারিধার,
নির্বাণ দীপ, রুদ্ধ দুয়ার,
শ্রাবণগগন করে হাহাকার
তিমিরশয়ন পাতি--
শুধু আমার মানিক আমারি বক্ষে
জ্বালায়ে রেখেছে বাতি।
কোথায় লুকাই, কেমনে নিবাই
নিলাজ ভূষণভাতি।


আমি আমার গোপন মরমের কথা
রেখেছি মরমতলে।
মলয় কহিছে আপন কাহিনী,
কোকিল গাহিছে আপন রাগিণী,
নদী বহি চলে কাঁদি একাকিনী
আপনার কলকলে--
শুধু আমার কোলের আমারি বীণাটি
গীতঝংকারছলে
যে কথা যখন করিব গোপন
সে কথা তখনি বলে।






 #111

গোয়ালিনী 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


হাটেতে চল পথের বাঁকে বাঁকে,
হে গোয়ালিনী, শিশুরে নিয়ে কাঁখে।
হাটের সাথে ঘরের সাথে
বেঁধেছ ডোর আপন হাতে
পরুষ কলকোলাহলের ফাঁকে।


হাটের পথে জানি না কোন্‌ ভুলে
কৃষ্ণকলি উঠিছে ভরি ফুলে।
কেনাবেচার বাহনগুলা
যতই কেন উড়াক ধুলা
তোমারি মিল সে ওই তরুমূলে।


শালিখপাখি আহারকণা-আশে
মাঠের 'পরে চরিছে ঘাসে ঘাসে।
আকাশ হতে প্রভাতরবি
দেখিছে সেই প্রাণের ছবি,
তোমারে আর তাহারে দেখে হাসে।


মায়েতে আর শিশুতে দোঁহে মিলে
ভিড়ের মাঝে চলেছ নিরিবিলে।
দুধের ভাঁড়ে মায়ের প্রাণ
মাধুরী তার করিল দান,
লোভের ভালে স্নেহের ছোঁওয়া দিলে।






 #112

ঘট ভরা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার এই ছোটো কলসখানি
সারা সকাল পেতে রাখি
ঝরনাধারার নিচে।
বসে থাকি একটি ধারে
শেওলাঢাকা পিছল কালো পাথরটাতে।
ঘট ভরে যায় বারে বারে--
ফেনিয়ে ওঠে, ছাপিয়ে পড়ে কেবলি।
সবুজ দিয়ে মিনে-করা
শৈলশ্রেণীর নীল আকাশে
ঝর্‌ঝরানির শব্দ ওঠে দিনে রাতে।
ভোরের ঘুমে ডাক শোনে তার
গাঁয়ের মেয়েরা।
জলের শব্দ যায় পেরিয়ে
বেগনি রঙের বনের সীমানা,
পাহাড়তলির রাস্তা ছেড়ে
যেখানে ঐ হাটের মানুষ
ধীরে ধীরে উঠছে চড়াইপথে,
বলদ দুটোর পিঠে বোঝাই
শুকনো কাঠের আঁটি;
রুনুঝুনু ঘণ্টা গলায় বাঁধা।
ঝর্‌ঝরানি আকাশ ছাপিয়ে
ভাবনা আমার ভাসিয়ে নিয়ে কোথায় চলে
পথহারানো দূর বিদেশে।
রাঙা ছিল সকালবেলার প্রথম রোদের রং
উঠল সাদা হয়ে।
বক উড়ে যায় পাহাড় পেরিয়ে।
বেলা হল ডাক পড়েছে ঘরে।
ওরা আমায় রাগ ক'রে কয়
"দেরি করলি কেন?"
চুপ করে সব শুনি;
ঘট ভরতে হয় না দেরি সবাই জানে,
উপচে-পড়া জলের কথা
বুঝবে না তো কেউ।






 #113

ঘরের খেয়া 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


সন্ধ্যা হয়ে আসে;
সোনা-মিশোল ধূসর আলো ঘিরল চারিপাশে।


নৌকোখানা বাঁধা আমার মধ্যিখানের গাঙে
অস্তরবির কাছে নয়ন কী যেন ধন মাঙে।
আপন গাঁয়ে কুটীর আমার দূরের পটে লেখা,
ঝাপসা আভায় যাচ্ছে দেখা বেগনি রঙের রেখা।
যাব কোথায় কিনারা তার নাই,
পশ্চিমেতে মেঘের গায়ে একটু আভাস পাই।
হাঁসের দলে উড়ে চলে হিমালয়ের পানে,
পাখা তাদের চিহ্নবিহীন পথের খবর জানে।
শ্রাবণ গেল, ভাদ্র গেল, শেষ হল জল-ঢালা,
আকাশতলে শুরু হল শুভ্র আলোর পালা।
খেতের পরে খেত একাকার প্লাবনে রয় ডুবে,
লাগল জলের দোলযাত্রা পশ্চিমে আর পুবে।
আসন্ন এই আঁধার মুখে নৌকোখানি বেয়ে
যায় কারা ঐ, শুধাই, "ওগো নেয়ে,
চলেছ কোন্‌খানে।"
যেতে যেতে জবাব দিল, "যাব গাঁয়ের পানে।"
অচিন শূন্যে ওড়া পাখি চেনে আপন নীড়,
জানে বিজনমধ্যে কোথায় আপন জনের ভিড়।
অসীম আকাশ মিলেছে ওর বাসার সীমানাতে,
ঐ অজানা জড়িয়ে আছে জানাশোনার সাথে|
তেমনি ওরা ঘরের পথিক ঘরের দিকে চলে
যেথায় ওদের তুলসিতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে।


দাঁড়ের শব্দ ক্ষীণ হয়ে যায় ধীরে,
মিলায় সুদূর নীরে।
সেদিন দিনের অবসানে সজল মেঘের ছায়ে
আমার চলার ঠিকানা নাই, ওরা চলল গাঁয়ে।






 #114

চড়িভাতি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ফল ধরেছে বটের ডালে ডালে;
অফুরন্ত আতিথ্যে তার সকালে বৈকালে
বনভোজনে পাখিরা সব আসছে ঝাঁকে ঝাঁক।
মাঠের ধারে আমার ছিল চড়িভাতির ডাক।
যে যার আপন ভাঁড়ার থেকে যা পেল যেইখানে
মালমসলা নানারকম জুটিয়ে সবাই আনে।
জাত-বেজাতের চালে ডালে মিশোল ক'রে শেষে
ডুমুরগাছের তলাটাতে মিলল সবাই এসে।
বারে বারে ঘটি ভ'রে জল তুলে কেউ আনে,
কেউ চলেছে কাঠের খোঁজে আমবাগানের পানে।
হাঁসের ডিমের সন্ধানে কেউ গেল গাঁয়ের মাঝে,
তিন কন্যা লেগে গেল রান্নাকরার কাজে।
গাঁঠ-পাকানো শিকড়েতে মাথাটা তার থুয়ে
কেউ পড়ে যায় গল্পের বই জামের তলায় শুয়ে।
সকল-কর্ম-ভোলা
দিনটা যেন ছুটির নৌকা বাঁধন-রশি-খোলা
চলে যাচ্ছে আপনি ভেসে সে কোন্‌ আঘাটায়
যথেচ্ছ ভাঁটায়।
মানুষ যখন পাকা ক'রে প্রাচীর তোলে নাই
মাঠে বনে শৈলগুহায় যখন তাহার ঠাঁই,
সেইদিনকার আল্‌গা-বিধির বাইরে-ঘোরা প্রাণ
মাঝে মাঝে রক্তে আজও লাগায় মন্ত্রগান।
সেইদিনকার যথেচ্ছ-রস আস্বাদনের খোঁজে
মিলেছিলেম অবেলাতে অনিয়মের ভোজে।
কারো কোনো স্বত্বদাবীর নেই যেখানে চিহ্ন,
যেখানে এই ধরাতলের সহজ দাক্ষিণ্য,
হালকা সাদা মেঘের নিচে পুরানো সেই ঘাসে,
একটা দিনের পরিচিত আমবাগানের পাশে,
মাঠের ধারে, অনভ্যাসের সেবার কাজে খেটে
কেমন ক'রে কয়টা প্রহর কোথায় গেল কেটে।
সমস্ত দিন ডাকল ঘুঘু দুটি।
আশে পাশে এঁটোর লোভে কাক এল সব জুটি,
গাঁয়ের থেকে কুকুর এল, লড়াই গেল বেধে--
একটা তাদের পালালো তার পরাভবের খেদে।

রৌদ্র পড়ে এল ক্রমে, ছায়া পড়ল বেঁকে,
ক্লান্ত গোরু গাড়ি টেনে চলেছে হাট থেকে।
আবার ধীরে ধীরে
নিয়ম-বাঁধা যে-যার ঘরে চলে গেলেম ফিরে।
একটা দিনের মুছল স্মৃতি, ঘুচল চড়িভাতি,
পোড়াকাঠের ছাই পড়ে রয়, নামে আঁধার রাতি।



আলমোড়া,
আষাঢ়, ১৩৪৪


#115

চতুর্থ সর্গ 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


"এ তবে স্বপন শুধু, বিম্বের মতন
আবার মিলায়ে গেল নিদ্রার সমুদ্রে!
সারারাত নিদ্রার করিনু আরাধনা--
যদি বা আইল নিদ্রা এ শ্রান্ত নয়নে,
মরীচিকা দেখাইয়া গেল গো মিলায়ে!
হা স্বপ্ন, কি শক্তি তোর, এ হেন মূরতি
মুহূর্ত্তের মধ্যে তুই ভাঙ্গিলি, গড়িলি?
হা নিষ্ঠুর কাল, তোর এ কিরূপ খেলা--
সত্যের মতন গড়িলি প্রতিমা,
স্বপ্নের মতন তাহা ফেলিলি ভাঙ্গিয়া?
কালের সমুদ্রে এক বিম্বের মতন
উঠিল, আবার গেল মিলায়ে তাহাতে?
না না, তাহা নয় কভু, নলিনী, সে কি গো
কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত!
যাহার মোহিনী মূর্ত্তি হৃদয়ে হৃদয়ে
শিরায় শিরায় আঁকা শোণিতের সাথে,
যত কাল রব বেঁচে যার ভালবাসা
চিরকাল এ হৃদয়ে রহিবে অক্ষয়,
সে বালিকা, সে নলিনী, সে স্বর্গপ্রতিমা,
কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত
তরঙ্গের অভিঘাতে জন্মিল মিশিল?
না না, তাহা নয় কভু, তা যেন না হয়!
দেহকারাগারমুক্ত সে নলিনী এবে
সুখে দুখে চিরকাল সম্পদে বিপদে
আমারই সাথে সাথে করিছে ভ্রমণ।
চিরহাস্যময় তার প্রেমদৃষ্টি মেলি
আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া।
রক্ষক দেবতা সম আমারি উপরে
প্রশান্ত প্রেমের ছায়া রেখেছে বিছায়ে।
দেহকারাগারমুক্ত হইলে আমিও
তাহার হৃদয়সাথে মিশাব হৃদয়।
নলিনী, আছ কি তুমি, আছ কি হেথায়?
একবার দেখা দেও, মিটাও সন্দেহ!
চিরকাল তরে তোরে ভুলিতে কি হবে?
তাই বল্ নলিনী লো, বল্ একবার!
চিরকাল আর তোরে পাব না দেখিতে,
চিরকাল আর তোর হৃদয়ে হৃদয়
পাব না কি মিশাইতে, বল্ একবার।
মরিলে কি পৃথিবীর সব যায় দূরে?
তুই কি আমারে ভুলে গেছিস্ নলিনি?
তা হোলে নলিনি, আমি চাই না মরিতে।
তোর ভালবাসা যেন চিরকাল মোর
হৃদয়ে অক্ষয় হোয়ে থাকে গো মুদ্রিত--
কষ্ট পাই পাব, তবু চাই না ভুলিতে!
তুমি নাহি থাক যদি তোমার স্মৃতিও
থাকে যেন এ হৃদয় করিয়া উজ্জ্বল!
এই ভালবাসা যাহা হৃদয়ে মরমে
অবশিষ্ট রাখে নাই এক তিল স্থান,
একটি পার্থিব ক্ষুদ্র নিশ্বাসের সাথে
মুহূর্ত্তে না পালটিতে আঁখির পলক
ক্ষণস্থায়ী কুসুমের সুরভের মত
শূন্য এই বায়ুস্রোতে যাইবে মিশায়ে?
হিমাদ্রির এই স্তব্ধ আঁধার গহ্বরে
সময়ের পদক্ষেপ গণিতেছি বসি,
ভবিষ্যৎ ক্রমে হইতেছে বর্ত্তমান,
বর্ত্তমান মিশিতেছে অতীতসমুদ্রে।
অস্ত যাইতেছে নিশি, আসিছে দিবস,
দিবস নিশার কোলে পড়িছে ঘুমায়ে।
এই সময়ের চক্র ঘুরিয়া নীরবে
পৃথিবীরে মানুষেরে অলক্ষিতভাবে
পরিবর্ত্তনের পথে যেতেছে লইয়া,
কিন্তু মনে হয় এই হিমাদ্রীর বুকে
তাহার চরণ-চিহ্ন পড়িছে না যেন।
কিন্তু মনে হয় যেন আমার হৃদয়ে
দুর্দ্দাম সময়স্রোত অবিরামগতি,
নূতন গড়ে নি কিছু, ভাঙ্গে নি পুরাণো।
বাহিরের কত কি যে ভাঙ্গিল চূরিল,
বাহিরের কত কি যে হইল নূতন,
কিন্তু ভিতরের দিকে চেয়ে দেখ দেখি--
আগেও আছিল যাহা এখনো তা আছে,
বোধ হয় চিরকাল থাকিবে তাহাই!
বরষে বরষে দেহ যেতেছে ভাঙ্গিয়া,
কিন্তু মন আছে তবু তেমনি অটল।
নলিনী নাইকো বটে পৃথিবীতে আর,
নলিনীরে ভালবাসি তবুও তেমনি।
যখন নলিনী ছিল, তখন যেমন
তার হৃদয়ের মূর্ত্তি ছিল এ হৃদয়ে,
এখনো তেমনি তাহা রয়েছে স্থাপিত।
এমন অন্তরে তারে রেখেছি লুকায়ে,
মরমের মর্ম্মস্থলে করিতেছি পূজা,
সময় পারে না সেথা কঠিন আঘাতে
ভাঙ্গিবারে এ জনমে সে মোর প্রতিমা,
হৃদয়ের আদরের লুকানো সে ধন!
ভেবেছিনু এক বার এই-যে বিষাদ
নিদারুণ তীব্র স্রোতে বহিছে হৃদয়ে
এ বুঝি হৃদয় মোর ভাঙ্গিবে চূরিবে--
পারে নি ভাঙ্গিতে কিন্তু এক তিল তাহা,
যেমন আছিল মন তেমনি রয়েছে!
বিষাদ যুঝিয়াছিল প্রাণপণে বটে,
কিন্তু এ হৃদয়ে মোর কি যে আছে বল,
এ দারুণ সমরে সে হইয়াচে জয়ী।
গাও গো বিহগ তব প্রমোদের গান,
তেমনি হৃদয়ে তার রবে প্রতিধ্বনি!
প্রকৃতি! মাতার মত সুপ্রসন্ন দৃষ্টি
যেমন দেখিয়াছিনু ছেলেবেলা আমি,
এখনো তেমনি যেন পেতেছি দেখিতে।
যা কিছু সুন্দর, দেবি, তাহাই মঙ্গল,
তোমার সুন্দর রাজ্যে হে প্রকৃতিদেবি
তিল অমঙ্গল কভু পারে না ঘটিতে।
অমন সুন্দর আহা নলিনীর মন,
জীবন সৌন্দর্য্য, দেবি তোমার এ রাজ্যে
অনন্ত কালের তরে হবে না বিলীন।
যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবে তা দেবি,
এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়।
তোমার আশ্বাসবাক্যে হে প্রকৃতিদেবি,
সংশয় কখনো আমি করি না স্বপনে!
বাজাও রাখাল তব সরল বাঁশরী!
গাও গো মনের সাধে প্রমোদের গান!
পাখীরা মেলিয়া যবে গাইতেছে গীত,
কানন ঘেরিয়া যবে বহিতেছে বায়ু,
উপত্যকাময় যবে ফুটিয়াছে ফুল,
তখন তোদের আর কিসের ভাবনা?
দেখি চিরহাস্যময় প্রকৃতির মুখ,
দিবানিশি হাসিবারে শিখেছিস্ তোরা!
সমস্ত প্রকৃতি যবে থাকে গো হাসিতে,
সমস্ত জগৎ যবে গাহে গো সঙ্গীত,
তখন ত তোরা নিজ বিজন কুটীরে
ক্ষুদ্রতম আপনার মনের বিষাদে
সমস্ত জগৎ ভুলি কাঁদিস না বসি!
জগতের, প্রকৃতির ফুল্ল মুখ হেরি
আপনার ক্ষুদ্র দুঃখ রহে কি গো আর?
ধীরে ধীরে দূর হোতে আসিছে কেমন
বসন্তের সুরভিত বাতাসের সাথে
মিশিয়া মিশিয়া এই সরল রাগিণী।
একেক রাগিণী আছে করিলে শ্রবণ
মনে হয় আমারি তা প্রাণের রাগিণী--
সেই রাগিণীর মত আমার এ প্রাণ,
আমার প্রাণের মত যেন সে রাগিণী!
কখন বা মনে হয় পুরাতন কাল
এই রাগিণীর মত আছিল মধুর,
এমনি স্বপনময় এমনি অস্ফুট--
পাই শুনি ধীরি ধীরি পুরাতন স্মৃতি
প্রাণের ভিতরে যেন উথলিয়া উঠে!"
ক্রমে কবি যৌবনের ছাড়াইয়া সীমা,
গম্ভীর বার্দ্ধক্যে আসি হোলো উপনীত!
সুগম্ভীর বৃদ্ধ কবি, স্কন্ধে আসি তার
পড়েছে ধবল জটা অযত্নে লুটায়ে!
মনে হোতো দেখিলে সে গম্ভীর মুখশ্রী
হিমাদ্রি হোতেও বুঝি সমুচ্চ মহান্!
নেত্র তাঁর বিকীরিত কি স্বর্গীয় জ্যোতি,
যেন তাঁর নয়নের শান্ত সে কিরণ
সমস্ত পৃথিবীময় শান্তি বরষিবে।
বিস্তীর্ণ হইয়া গেল কবির সে দৃষ্টি,
দৃষ্টির সম্মুখে তার, দিগন্তও যেন
খুলিয়া দিত গো নিজ অভেদ্য দুয়ার।
যেন কোন দেববালা কবিরে লইয়া
অনন্ত নক্ষত্রলোকে কোরেছে স্থাপিত--
সামান্য মানুষ যেথা করিলে গমন
কহিত কাতর স্বরে ঢাকিয়া নয়ন,
"এ কি রে অনন্ত কাণ্ড, পারি না সহিতে!"
সন্ধ্যার আঁধারে হোথা বসিয়া বসিয়া,
কি গান গাইছে কবি, শুন কলপনা।
কি "সুন্দর সাজিয়াছে ওগো হিমালয়
তোমার বিশালতম শিখরের শিরে
একটি সন্ধ্যার তারা! সুনীল গগন
ভেদিয়া, তুষারশুভ্র মস্তক তোমার!
সরল পাদপরাজি আঁধার করিয়া
উঠেছে তাহার পরে; সে ঘোর অরণ্য
ঘেরিয়া হুহুহু করি তীব্র শীতবায়ু
দিবানিশি ফেলিতেছে বিষণ্ণ নিশ্বাস!
শিখরে শিখরে ক্রমে নিভিয়া আসিল
অস্তমান তপনের আরক্ত কিরণে
প্রদীপ্ত জলদচূর্ণ। শিখরে শিখরে
মলিন হইয়া এল উজ্জ্বল তুষার,
শিখরে শিখরে ক্রমে নামিয়া আসিল
আঁধারের যবনিকা ধীরে ধীরে ধীরে!
পর্ব্বতের বনে বনে গাঢ়তর হোলো
ঘুমময় অন্ধকার। গভীর নীরব!
সাড়াশব্দ নাই মুখে, অতি ধীরে ধীরে
অতি ভয়ে ভয়ে যেন চলেছে তটিনী
সুগম্ভীর পর্ব্বতের পদতল দিয়া!
কি মহান্! কি প্রশান্ত! কি গম্ভীর ভাব!
ধরার সকল হোতে উপরে উঠিয়া
স্বর্গের সীমায় রাখি ধবল জটায়
জড়িত মস্তক তব ওগো হিমালয়
নীরব ভাষায় তুমি কি যেন একটি
গম্ভীর আদেশ ধীরে করিছ প্রচার!
সমস্ত পৃথিবী তাই নীরব হইয়া
শুনিছে অনন্যমনে সভয়ে বিস্ময়ে।
আমিও একাকী হেথা রয়েছি পড়িয়া,
আঁধার মহা-সমুদ্রে গিয়াছি মিশায়ে,
ক্ষুদ্র হোতে ক্ষুদ্র নর আমি, শৈলরাজ!
অকূল সমুদ্রে ক্ষুদ্র তৃণটির মত
হারাইয়া দিগ্বিদিক্, হারাইয়া পথ,
সভয়ে বিস্ময়ে, হোয়ে হতজ্ঞানপ্রায়
তোমার চরণতলে রয়েছি পড়িয়া।
ঊর্দ্ধ্বমুখে চেয়ে দেখি ভেদিয়া আঁধার
শূন্যে শূন্যে শত শত উজ্জ্বল তারকা,
অনিমিষ নেত্রগুলি মেলিয়া যেন রে
আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া।
ওগো হিমালয়, তুমি কি গম্ভীর ভাবে
দাঁড়ায়ে রয়েছ হেথা অচল অটল,
দেখিছ কালের লীলা, করিছ গননা,
কালচক্র কত বার আইল ফিরিয়া!
সিন্ধুর বেলার বক্ষে গড়ায় যেমন
অযুত তরঙ্গ, কিছু লক্ষ্য না করিয়া
কত কাল আইল রে, গেল কত কাল
হিমাদ্রি তোমার ওই চক্ষের উপরি।
মাথার উপর দিয়া কত দিবাকর
উলটি কালের পৃষ্ঠা গিয়াছে চলিয়া।
গম্ভীর আঁধারে ঢাকি তোমার ও দেহ
কত রাত্রি আসিয়াছে গিয়াছে পোহায়ে।
কিন্তু বল দেখি ওগো হিমালয়গিরি
মানুষসৃষ্টির অতি আরম্ভ হইতে
কি দেখিছ এইখানে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে?
যা দেখিছ যা দেখেছ তাতে কি এখনো
সর্ব্বাঙ্গ তোমার গিরি উঠে নি শিহরি?
কি দারুণ অশান্তি এই মনুষ্যজগতে--
রক্তপাত, অত্যাচার , পাপ কোলাহল
দিতেছে মানবমনে বিষ মিশাইয়া!
কত কোটি কোটি লোক, অন্ধকারাগারে
অধীনতাশৃঙ্খলেতে আবদ্ধ হইয়া
ভরিছে স্বর্গের কর্ণ কাতর ক্রন্দনে,
অবশেষে মন এত হোয়েছে নিস্তেজ,
কলঙ্কশৃঙ্খল তার অলঙ্কাররূপে
আলিঙ্গন ক'রে তারে রেখেছে গলায়!
দাসত্বের পদধূলি অহঙ্কার কোরে
মাথায় বহন করে পরপ্রত্যাশীরা!
যে পদ মাথায় করে ঘৃণার আঘাত
সেই পদ ভক্তিভরে করে গো চুম্বন!
যে হস্ত ভ্রাতারে তার পরায় শৃঙ্খল,
সেই হস্ত পরশিলে স্বর্গ পায় করে।
স্বাধীন, সে অধীনেরে দলিবার তরে,
অধীন, সে স্বাধীনেরে পূজিবারে শুধু!
সবল, সে দুর্ব্বলেরে পীড়িতে কেবল--
দুর্ব্বল, বলের পদে আত্ম বিসর্জ্জিতে!
স্বাধীনতা কারে বলে জানে সেই জন
কোথায় সেই অসহায় অধীন জনের
কঠিন শৃঙ্খলরাশি দিবে গো ভাঙ্গিয়া,
না, তার স্বাধীন হস্ত হোয়েছে কেবল
অধীনের লৌহপাশ দৃঢ় করিবারে।
সবল দুর্ব্বলে কোথা সাহায্য করিবে--
দুর্ব্বলে অধিকতর করিতে দুর্ব্বল
বল তার-- হিমগিরি, দেখিছ কি তাহা?
সামান্য নিজের স্বার্থ করিতে সাধন
কত দেশ করিতেছে শ্মশান অরণ্য,
কোটি কোটি মানবের শান্তি স্বাধীনতা
রক্তময়পদাঘাতে দিতেছে ভাঙ্গিয়া,
তবুও মানুষ বলি গর্ব্ব করে তারা,
তবু তারা সভ্য বলি করে অহঙ্কার!
কত রক্তমাখা ছুরি হাসিছে হরষে,
কত জিহ্বা হৃদয়েরে ছিঁড়িছে বিঁধিছে!
বিষাদের অশ্রুপূর্ণ নয়ন হে গিরি
অভিশাপ দেয় সদা পরের হরষে,
উপেক্ষা ঘৃণায় মাখা কুঞ্চিত অধর
পরঅশ্রুজলে ঢালে হাসিমাখা বিষ!
পৃথিবী জানে না গিরি হেরিয়া পরের জ্বালা,
হেরিয়া পরের মর্ম্মদুখের উচ্ছ্বাস,
পরের নয়নজলে মিশাতে নয়নজল--
পরের দুখের শ্বাসে মিশাতে নিশ্বাস!
প্রেম? প্রেম কোথা হেথা এ অশান্তিধামে?
প্রণয়ের ছদ্মবেশ পরিয়া যেথায়
বিচরে ইন্দ্রিয়সেবা, প্রেম সেথা আছে?
প্রেমে পাপ বলে যারা, প্রেম তারা চিনে?
মানুষে মানুষে যেথা আকাশ পাতাল,
হৃদয়ে হৃদয়ে যেথা আত্ম-অভিমান,
যে ধরায় মন দিয়া ভাল বাসে যারা
উপেক্ষা বিদ্বেষ ঘৃণা মিথ্যা অপবাদে
তারাই অধিক সহে বিষাদ যন্ত্রণা,
সেথা যদি প্রেম থাকে তবে কোথা নাই--
তবে প্রেম কলুষিত নরকেও আছে!
কেহ বা রতনময় কনকভবনে
ঘুমায়ে রয়েছে সুখে বিলাসের কোলে,
অথচ সুমুখ দিয়া দীন নিরালয়
পথে পথে করিতেছে ভিক্ষান্নসন্ধান!
সহস্র পীড়িতদের অভিশাপ লোয়ে
সহস্রের রক্তধারে ক্ষালিত আসনে
সমস্ত পৃথিবী রাজা করিছে শাসন,
বাঁধিয়া গলায় সেই শাসনের রজ্জু
সমস্ত পৃথিবী তাহার রহিয়াছে দাস!
সহস্র পীড়ন সহি আনত মাথায়
একের দাসত্বে রত অযুত মানব!
ভাবিয়া দেখিলে মন উঠে গো শিহরি--
ভ্রমান্ধ দাসের জাতি সমস্ত মানুষ।
এ অশান্তি কবে দেব হবে দূরীভূত!
অত্যাচার-গুরুভারে হোয়ে নিপীড়িত
সমস্ত পৃথিবী, দেব, করিছে ক্রন্দন!
সুখ শান্তি সেথা হোতে লয়েছে বিদায়!
কবে, দেব, এ রজনী হবে অবসান?
স্নান করি প্রভাতের শিশিরসলিলে
তরুণ রবির করে হাসিবে পৃথিবী!
অযুত মানবগণ এক কণ্ঠে, দেব,
এক গান গাইবেক স্বর্গ পূর্ণ করি!
নাইক দরিদ্র ধনী অধিপতি প্রজা--
কেহ কারো কুটীরেতে করিলে গমন
মর্য্যাদার অপমান করিবে না মনে,
সকলেই সকলের করিতেছে সেবা,
কেহ কারো প্রভু নয়, নহে কারো দাস!
নাই ভিন্ন জাতি আর নাই ভিন্ন ভাষা
নাই ভিন্ন দেশ, ভিন্ন আচার ব্যাভার!
সকলেই আপনার আপনার লোয়ে
পরিশ্রম করিতেছে প্রফুল্ল-অন্তরে।
কেহ কারো সুখে নাহি দেয় গো কণ্টক,
কেহ কারো দুখে নাহি করে উপহাস!
দ্বেষ নিন্দা ক্রূরতার জঘন্য আসন
ধর্ম্ম-আবরণে নাহি করে গো সজ্জিত!
হিমাদ্রি, মানুষসৃষ্টি-আরম্ভ হইতে
অতীতের ইতিহাস পড়েছ সকলি,
অতীতের দীপশিখা যদি হিমালয়
ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পারে গো ভেদিতে
তবে বল কবে, গিরি, হবে সেই দিন
যে দিন স্বর্গই হবে পৃথ্বীর আদর্শ!
সে দিন আসিবে গিরি, এখনিই যেন
দূর ভবিষ্যৎ সেই পেতেছি দেখিতে
যেই দিন এক প্রেমে হইয়া নিবদ্ধ
মিলিবেক কোটি কোটি মানবহৃদয়।
প্রকৃতির সব কার্য্য অতি ধীরে ধীরে,
এক এক শতাব্দীর সোপানে সোপানে--
পৃথ্বী সে শান্তির পথে চলিতেছে ক্রমে,
পৃথিবীর সে অবস্থা আসে নি এখনো
কিন্তু এক দিন তাহা আসিবে নিশ্চয়।
আবার বলি গো আমি হে প্রকৃতিদেবি
যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবেক তাহা,
এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়।
এ যে সুখময় আশা দিয়াছ হৃদয়ে
ইহার সঙ্গীত, দেবি, শুনিতে শুনিতে
পারিব হরষচিতে ত্যজিতে জীবন!"
সমস্ত ধরার তরে নয়নের জল
বৃদ্ধ সে কবির নেত্র করিল পূর্ণিত!
যথা সে হিমাদ্রি হোতে ঝরিয়া ঝরিয়া
কত নদী শত দেশ করয়ে উর্ব্বরা।
উচ্ছ্বসিত করি দিয়া কবির হৃদয়
অসীম করুণা সিন্ধু পোড়েছে ছড়ায়ে
সমস্ত পৃথিবীময়। মিলি তাঁর সাথে
জীবনের একমাত্র সঙ্গিনী ভারতী
কাঁদিলেন আর্দ্র হোয়ে পৃথিবীর দুখে,
ব্যাধশরে নিপতিত পাখীর মরণে
বাল্মীকির সাথে যিনি করেন রোদন!
কবির প্রাচীননেত্রে পৃথিবীর শোভা
এখনও কিছু মাত্র হয় নি পুরাণো?
এখনো সে হিমাদ্রির শিখরে শিখরে
একেলা আপন মনে করিত ভ্রমণ।
বিশাল ধবল জটা, বিশাল ধবল শ্মশ্রু,
নেত্রের স্বর্গীয় জ্যোতি, গম্ভীর মূরতি,
প্রশস্ত ললাটদেশ, প্রশান্ত আকৃতি তার
মনে হোত হিমাদ্রির অধিষ্ঠাতৃদেব!
জীবনের দিন ক্রমে ফুরায় কবির!
সঙ্গীত যেমন ধীরে আইসে মিলায়ে,
কবিতা যেমন ধীরে আইসে ফুরায়ে,
প্রভাতের শুকতারা ধীরে ধীরে যথা
ক্রমশঃ মিশায়ে আসে রবির কিরণে,
তেমনি ফুরায়ে এল কবির জীবন।
প্রতিরাত্রে গিরিশিরে জোছনায় বসি
আনন্দে গাইত কবি সুখের সঙ্গীত।
দেখিতে পেয়েছে যেন স্বর্গের কিরণ,
শুনিতে পেয়েছে যেন দূর স্বর্গ হোতে,
নলিনীর সুমধুর আহ্বানের গান।
প্রবাসী যেমন আহা দূর হোতে যদি
সহসা শুনিতে পায় স্বদেশ-সঙ্গীত,
ধায় হরষিত চিতে সেই দিক্ পানে,
একদিন দুইদিন যেতেছে যেমন
চলেছে হরষে কবি সেই দেশ হোতে
স্বদেশসঙ্গীতধ্বনি পেতেছে শুনিতে।
এক দিন হিমাদ্রির নিশীথ বায়ুতে
কবির অন্তিম শ্বাস গেল মিশাইয়া!
হিমাদ্রি হইল তার সমাধিমন্দির,
একটি মানুষ সেথা ফেলে নি নিশ্বাস!
প্রত্যহ প্রভাত শুধু শিশিরাশ্রুজলে
হরিত পল্লব তার করিত প্লাবিত!
শুধু সে বনের মাঝে বনের বাতাস,
হুহু করি মাঝে মাঝে ফেলিত নিশ্বাস!
সমাধি উপরে তার তরুলতাকুল
প্রতিদিন বরষিত কত শত ফুল!
কাছে বসি বিহগেরা গাইত গো গান,
তটিনী তাহার সাথে মিশাইত তান।






 #116

চিত্ত তোমায় নিত্য হবে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে
সত্য হবে -
ওগো সত্য, আমার এখন সুদিন।
ঘটবে কবে।
সত্য সত্য সত্য জপি,
সকল বুদ্ধি সত্যে সঁপি,
সীমার বাঁধন পেরিয়ে যাব
নিখিল ভবে -
সত্য তোমার পূর্ণ প্রকাশ
দেখব কবে।

তোমায় দূরে সরিয়ে মরি
আপন অসত্যে।
কী যে কান্ড করি গো সেই
ভূতের রাজত্বে।
আমার আমি ধুয়ে মুছে
তোমার মধ্যে যাবে ঘুচে,
সত্য, তোমায় সত্য হব
বাঁচব তবে -
তোমার মধ্যে মরণ আমার
মরবে কবে।


১৫ শ্রাবণ ১৩১৭
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ১৩৭






 #117

চিত্রা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী।
অযুত আলোকে ঝলসিছ নীল গগনে,
আকুল পুলকে উলসিছ ফুলকাননে,
দ্যুলোকে ভূলোকে বিলসিছ চলচরণে,
তুমি চঞ্চলগামিনী।
মুখর নূপুর বাজিছে সুদূর আকাশে,
অলকগন্ধ উড়িছে মন্দ বাতাসে,
মধুর নৃত্যে নিখিল চিত্তে বিকাশে
কত মঞ্জুল রাগিণী।
কত না বর্ণে কত না স্বর্ণে গঠিত
কত যে ছন্দে কত সংগীতে রটিত
কত না গ্রন্থে কত না কণ্ঠে পঠিত
তব অসংখ্য কাহিনী।
জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী।


অন্তরমাঝে শুধু তুমি একা একাকী
তুমি অন্তরব্যাপিনী।
একটি স্বপ্ন মুগ্ধ সজল নয়নে,
একটি পদ্ম হৃদয়বৃন্তশয়নে,
একটি চন্দ্র অসীম চিত্তগগনে--
চারি দিকে চিরযামিনী।
অকূল শান্তি সেথায় বিপুল বিরতি,
একটি ভক্ত করিছে নিত্য আরতি,
নাহি কাল দেশ, তুমি অনিমেষ মুরতি--
তুমি অচপলদামিনী।
ধীর গম্ভীর গভীর মৌনমহিমা,
স্বচ্ছ অতল স্নিগ্ধ নয়ননীলিমা
স্থির হাসিখানি উষালোকসম অসীমা,
অয়ি প্রশান্তহাসিনী।
অন্তরমাঝে তুমি শুধু একা একাকী
তুমি অন্তরবাসিনী।






 #118

চির-আমি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে -
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,
কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,
ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,
শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় -
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

যখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,
কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে।
ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সেদিন উঠবে ভরি,
চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ওই মাঠে।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।


(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)






 #119

চিরায়মানা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।
বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথি নাহয় বাঁকা হবে,
নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।
কাঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।
যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।।

এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।
ভয় কোরো না - অলক্তরাগ মোছে যদি মুছিয়া যাক,
নূপুর যদি খুলে পড়ে নাহয় রেখে এলে।
খেদ কোরো না মালা হতে মুক্তা খসে গেলে।
এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।

হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।
ও পার হতে দলে দলে বকের শ্রেণী উড়ে চলে,
থেকে থেকে শূন্য মাঠে বাতাস ওঠে জেগে।
ওই রে গ্রামের গোষ্ঠমুখে ধেনুরা ধায় বেগে।
হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।।

প্রদীপখানি নিবে যাবে, মিথ্যা কেন জ্বালো?
কে দেখতে পায় চোখের কাছে কাজল আছে কি না আছে,
তরল তব সজল দিঠি মেঘের চেয়ে কালো।
আঁখির পাতা যেমন আছে এমনি থাকা ভালো।
কাজল দিতে প্রদীপখানি মিথ্যা কেন জ্বালো?।

এসো হেসে সহজ বেশে, আর কোরো না সাজ।
গাঁথা যদি না হয় মালা ক্ষতি তাহে নাই গো বালা,
ভূষণ যদি না হয় সারা ভূষণে নাই কাজ।
মেঘ মগন পূর্বগগন, বেলা নাই রে আজ।
এসো হেসে সহজ বেশে, নাই-বা হল সাজ।।



শিলাইদহ, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৭
(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)






 #120

চেয়ে থাকা 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মনেতে সাধ যে দিকে চাই
কেবলি চেয়ে রব।
দেখিব শুধু, দেখিব শুধু,
কথাটি নাহি কব।
পরানে শুধু জাগিবে প্রেম,
নয়নে লাগে ঘোর,
জগতে যেন ডুবিয়া রব
হইয়া রব ভোর।
তটিনী যায়, বহিয়া যায়,
কে জানে কোথা যায়;
তীরেতে বসে রহিব চেয়ে,
সারাটি দিন যায়।
সুদূর জলে ডুবিছে রবি
সোনার লেখা লিখি,
সাঁঝের আলো জলেতে শুয়ে
করিছে ঝিকিমিকি।
সুধীর স্রোতে তরণীগুলি
যেতেছে সারি সারি,
বহিয়া যায়, ভাসিয়া যায়
কত-না নরনারী।
না জানি তারা কোথায় থাকে
যেতেছে কোন্‌ দেশে,
সুদূর তীরে কোথায় গিয়ে
থামিবে অবশেষে।
কত কী আশা গড়িছে বসে
তাদের মনখানি,
কত কী সুখ কত কী দুখ
কিছুই নাহি জানি।

দেখিব পাখি আকাশে ওড়ে,
সুদূরে উড়ে যায়,
মিশায়ে যায় কিরণমাঝে,
আঁধাররেখাপ্রায়!
তাহারি সাথে সারাটি দিন
উড়িবে মোর প্রাণ,
নীরবে বসে তাহারি সাথে
গাহিব তারি গান।
তাহারি মতো মেঘের মাঝে
বাঁধিতে চাহি বাসা,
তাহারি মতো চাঁদের কোলে
গড়িতে চাহি আশা!
তাহারি মতো আকাশে উঠে,
ধরার পানে চেয়ে
ধরায় যারে এসেছি ফেলে
ডাকিব গান গেয়ে।
তাহারি মতো, তাহারি সাথে
উষার দ্বারে গিয়ে,
ঘুমের ঘোর ভাঙায়ে দিব
উষারে জাগাইয়ে।

পথের ধারে বসিয়া রব
বিজন তরুছায়,
সমুখ দিয়ে পথিক যত
কত-না আসে যায়
ধুলায় বসে আপন-মনে
ছেলেরা খেলা করে,
মুখেতে হাসি সখারা মিলে
যেতেছে ফিরে ঘরে।

পথের ধারে ঘরের দ্বারে
বালিকা এক মেয়ে,
ছোটো ভায়েরে পাড়ায় ঘুম
কত কী গান গেয়ে।
তাহার পানে চাহিয়া থাকি
দিবস যায় চলে,
স্নেহেতে ভরা করুণ আঁখি—
হৃদয় যায় গলে।
এতটুকু সে পরানটিতে
এতটা সুধারাশি ।
কাছেতে তাই দাঁড়ায়ে তারে
দেখিতে ভালোবাসি।

কোথা বা শিশু কাঁদিছে পথে
মায়েরে ডাকি ডাকি,
আকুল হয়ে পথিকমুখে
চাহিছে থাকি থাকি।
কাতর স্বর শুনিতে পেয়ে
জননী ছুটে আসে,
মায়ের বুক জড়ায়ে শিশু
কাঁদিতে গিয়ে হাসে।
অবাক হয়ে তাহাই দেখি
নিমেষ ভুলে গিয়ে,
দুইটি ফোঁটা বাহিরে জল
দুইটি আঁখি দিয়ে।

যায় রে সাধ জগৎ-পানে
কেবলি চেয়ে রই
অবাক হয়ে, আপনা ভুলে,
কথাটি নাহি কই।






 #121

ছবি-আঁকিয়ে 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ছবি আঁকার মানুষ ওগো পথিক চিরকেলে,
চলছ তুমি আশেপাশে দৃষ্টির জাল ফেলে।
পথ-চলা সেই দেখাগুলো লাইন দিয়ে এঁকে
পাঠিয়ে দিলে দেশ-বিদেশের থেকে।
যাহা-তাহা যেমন-তেমন আছে কতই কী যে,
তোমার চোখে ভেদ ঘটে নাই চণ্ডালে আর দ্বিজে।
ঐ যে গরিবপাড়া,
আর কিছু নেই ঘেঁষাঘেঁষি কয়টা কুটীর ছাড়া।
তার ওপারে শুধু
চৈত্রমাসের মাঠ করছে ধু ধু।
এদের পানে চক্ষু মেলে কেউ কভু কি দাঁড়ায়,
ইচ্ছে ক'রে এ ঘরগুলোর ছায়া কি কেউ মাড়ায়।
তুমি বললে, দেখার ওরা অযোগ্য নয় মোটে;
সেই কথাটিই তুলির রেখায় তক্ষনি যায় রটে।
হঠাৎ তখন ঝেঁকে উঠে আমরা বলি, তাই তো,
দেখার মতোই জিনিস বটে, সন্দেহ তার নাই তো।


ঐযে কারা পথে চলে, কেউ করে বিশ্রাম,
নেই বললেই হয় ওরা সব, পোঁছে না কেউ নাম--
তোমার কলম বললে, ওরা খুব আছে এই জেনো;
অমনি বলি, তাই বটে তো, সবাই চেনো-চেনো।
ওরাই আছে, নেইকো কেবল বাদশা কিংবা নবাব;
এই ধরণীর মাটির কোলে থাকাই ওদের স্বভাব।
অনেক খরচ ক'রে রাজা আপন ছবি আঁকায়,
তার পানে কি রসিক লোকে কেউ কখনো তাকায়।
সে-সব ছবি সাজে-সজ্জায় বোকার লাগায় ধাধাঁ,
আর এরা সব সত্যি মানুষ সহজ রূপেই বাঁধা।


ওগো চিত্রী, এবার তোমার কেমন খেয়াল এ যে,
এঁকে বসলে ছাগল একটা উচ্চশ্রবা ত্যেজে।
জন্তুটা তো পায় না খাতির হঠাৎ চোখে ঠেকলে,
সবাই ওঠে হাঁ হাঁ ক'রে সবজি-খেতে দেখলে।
আজ তুমি তার ছাগলামিটা ফোটালে যেই দেহে
এক মুহূর্তে চমক লেগে বলে উঠলেম, কে হে।
ওরে ছাগলওয়ালা, এটা তোরা ভাবিস কার--
আমি জানি, একজনের এই প্রথম আবিষ্কার।






 #122

ছয় 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অতিথিবৎসল,
ডেকে নাও পথের পথিককে
তোমার আপন ঘরে,
দাও ওর ভয় ভাঙিয়ে।
ও থাকে প্রদোষের বস্‌তিতে,
নিজের কালো ছায়া ওর সঙ্গে চলে
কখনো সমুখে কখনো পিছনে,
তাকেই সত্য ভেবে ওর যত দুঃখ যত ভয়।
দ্বারে দাঁড়িয়ে তোমার আলো তুলে ধরো,
ছায়া যাক মিলিয়ে,
থেমে যাক ওর বুকের কাঁপন।

বছরে বছরে ও গেছে চলে
তোমার আঙিনার সামনে দিয়ে,
সাহস পায় নি ভিতরে যেতে,
ভয় হয়েছে পাছে ওর বাইরের ধন
হারায় সেখানে।
দেখিয়ে দাও ওর আপন বিশ্ব
তোমার মন্দিরে,
সেখানে মুছে গেছে কাছের পরিচয়ের কালিমা,
ঘুচে গেছে নিত্যব্যবহারের জীর্ণতা,
তার চিরলাবণ্য হয়েছে পরিস্ফুট।

পান্থশালায় ছিল ওর বাসা,
বুকে আঁকড়ে ছিল তারই আসন, তারই শয্যা,
পলে পলে যার ভাড়া জুগিয়ে দিন কাটালো
কোন্‌ মুহূর্তে তাকে ছাড়বে ভয়ে
আড়াল তুলেছে উপকরণের।
একবার ঘরের অভয় স্বাদ পেতে দাও তাকে
বেড়ার বাইরে।

আপনাকে চেনার সময় পায় নি সে,
ঢাকা ছিল মোটা মাটির পর্দায়;
পর্দা খুলে দেখিয়ে দাও যে, সে আলো, সে আনন্দ,
তোমারই সঙ্গে তার রূপের মিল।
তোমার যজ্ঞের হোমাগ্নিতে
তার জীবনের সুখদুঃখ আহুতি দাও,
জ্বলে উঠুক তেজের শিখায়,
ছাই হোক যা ছাই হবার।

হে অতিথিবৎসল,
পথের মানুষকে ডেকে নাও ঘরে,
আপনি যে ছিল আপনার পর হয়ে
সে পাক্‌ আপনাকে।



শান্তিনিকেতন, ২৪ অক্টোবর ১৯৩৫






 #123

ছল 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি এত লীলার ছল -
বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা -
যে কথা তুমি বলিতে চাও সে কথা তুমি বল না।।

তোমারে পাছে সহজে ধরি কিছুরই তব কিনারা নাই -
দশের দলে টানি গো পাছে কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা -
যে পথে তুমি চলিতে চাও সে পথে তুমি চল না।।

সবার চেয়ে অধিক চাহ, তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও -
হেলার ভরে খেলার মতো ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও?
বুঝেছি আমি, বুজেছি তব ছলনা -
সবার যাহে তৃপ্তি হল তোমার তাহে হল না।।


(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)






 #124

ছায়াছবি 


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার প্রিয়ার সচল ছায়াছরি
সজল নীলাকাশে।
আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
সন্ধ্যাদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার ভাসে।
বারিঝরা বনের গন্ধ নিয়া
পরশহারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
আকাশ ছেয়ে মনের কথা হারায়,
আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে।








 #125
ছায়াসঙ্গিনী 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কোন্‌ ছায়াখানি
সঙ্গে তব ফেরে লয়ে স্বপ্নরুদ্ধ বাণী
তুমি কি আপনি তাহা জানো।
চোখের দৃষ্টিতে তব রয়েছে বিছানো।
আপনাবিস্মৃত তারি।
স্তম্ভিত স্তিমিত অশ্রুবারি।


একদিন জীবনের প্রথম ফাল্গুনী
এসেছিল, তুমি তারি পদধ্বনি শুনি
কম্পিত কৌতুকী
যেমনি খুলিয়া দ্বার দিলে উঁকি
আম্রমঞ্জরির গন্ধে মধুপগুঞ্জনে
হৃদয়স্পন্দনে
এক ছন্দে মিলে গেল বনের মর্মর।
অশোকের কিশলয়স্তর
উৎসুক যৌবনে তব বিস্তারিল নবীন রক্তিমা।
প্রাণোচ্ছ্বাস নাহি পায় সীমা
তোমার আপনা-মাঝে,
সে-প্রাণেরই ছন্দ বাজে
দূর নীল বনান্তের বিহঙ্গসংগীতে,
দিগন্তে নির্জনলীন রাখালের করুণ বংশীতে।
তব বনচ্ছায়ে
আসিল অতিথি পান্থ, তৃণস্তরে দিল সে বিছায়ে
উত্তরী-অংশুকে তার সুবর্ণ পূর্ণিমা
চম্পকবর্ণিমা।
তারি সঙ্গে মিশে
প্রভাতের মৃদু রৌদ্র দিশে দিশে
তোমার বিধুর হিয়া
দিল উচ্ছ্বাসিয়া।


তার পর সসংকোচে বদ্ধ করি দিলে তব দ্বার,
উচ্ছৃঙ্খল সমীরণে উদ্দাম কুন্তলভার
লইলে সংযত করি--
অশান্ত তরুণ প্রেম বসন্তের পন্থ অনুসরি
স্খলিত কিংশুক-সাথে
জীর্ণ হল ধূসর ধুলাতে।


তুমি ভাবো সেই রাত্রিদিন
চিহ্নহীন
মল্লিকাগন্ধের মতো
নির্বিশেষে গত।
জানো না কি যে-বসন্ত সম্বরিল কায়া
তারি মৃত্যুহীন ছায়া
অহর্নিশি আছে তব সাথে সাথে
তোমার অজ্ঞাতে।
অদৃশ্য মঞ্জরি তার আপনার রেণুর রেখায়
মেশে তব সীমন্তের সিন্দূরলেখায়।
সুদূর সে ফাল্গুনের স্তব্ধ সুর
তোমার কণ্ঠের স্বর করি দিল উদাত্ত মধুর।
যে চাঞ্চল্য হয়ে গেছে স্থির
তারি মন্ত্রে চিত্ত তব সকরুণ, শান্ত, সুগম্ভীর।





 #92
কে 

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো !
সে যে ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে,
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত ।

সে চলে গেল , বলে গেল না ,
সে কোথায় গেল ফিরে এল না ,
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল ,
কী যেন গেয়ে গেল--
তাই আপন মনে বসে আছি
কুসুম-বনেতে ।

সে ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে ,
চঁদের আলোর দেশে গেছে ,
যেখান দিয়ে হেসে গেছে
হাসি তার রেখে গেছে রে ।
মনে হল আঁখির কোণে
আমায় যেন ডেকে গেছে সে ।
আমি কোথায় যাব কোথায় যাব ,
ভাবতেছি তাই একলা বসে ।

সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল
ঘুমের ঘোর ।
সে প্রাণের কোথা দুলিয়ে গেল
ফুলের ডোর ।
সে কুসুম-বনের উপর দিয়ে
কী কথা যে বলে গেল ,
ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে
সঙ্গে তারি চলে গেল ।
হৃদয় আমার আকুল হল ,
নয়ন আমার মুদে এল ,
কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে!








রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন